
দলে তরুণ এসে রাজ্যজয়ের ইঙ্গিত দিলে ‘ছোটে’ নামকরণ হয়ে যায়। তাই মাশরাফি বিন মর্তুজা যখন টেলিফোনে সাকিব আল হাসানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছোটের বোলিং দেখতেছিস’, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে এই ‘ছোটে’ কে? অবধারিতভাবে তিনি মুস্তাফিজুর রহমান। আগের রাতেই কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে ৪ ওভারে ৯ রানে ২ উইকেট নেওয়া ‘ফিজ’ যে সুপারস্পেশাল—সাকিবের সঙ্গে মাশরাফির কথোপকথন তার একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি মাত্র। মুস্তাফিজুর রহমানকে তো সেই কবে থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা প্রতিভার মর্যাদা দিয়ে রেখেছেন মাশরাফি।
বিপথে যাওয়া মোহাম্মদ আশরাফুলের প্রতিভা নিয়ে কোনো সংশয় নেই ক্রিকেটাঙ্গনের। মুস্তাফিজের আগমনের আগে পুরনো বন্ধুই ছিলেন মাশরাফির দেখা বাংলাদেশের সেরা প্রতিভা। কাল মিরপুরে ক্লাব প্র্যাকটিস শেষে মাশরাফি নির্দ্বিধায় বলে দিলেন, ‘আশরাফুলের চেয়েও বড় প্রতিভা মুস্তাফিজ। আমার মনে হয় না এমন কাউকে দেখেছি আগে। গড গিফটেড প্রতিভা যাকে বলে।’
বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে ‘ছোটে’ যুগে যুগে কম আসেনি, আবার ঝরেও গেছে। কিন্তু সেসব ‘ছোটে’র পরিণতি এ যুগের মুস্তাফিজকে নিয়ে মোটেও ভাবায় না মাশরাফিকে, ‘মুস্তাফিজ অনেক স্মার্ট, জানে কিভাবে নিজেকে পরিচর্যা করতে হয়। জাতীয় দলে তো কম দিন হয় না খেলছি। কিন্তু ওর মতো নিজের ব্যাপারে এত সচেতন কাউকে দেখিনি।’ উঠতি প্রতিভাকে সচেতন করার উদ্যোগ দলের পক্ষ থেকে বরাবরই নেওয়া হয়ে থাকে। খেলা না থাকলেও ফিজিও-ট্রেনার রুটিন ধরিয়ে দেন। সিংহভাগ প্রেসক্রিপশন মেনে চলেন। তবু অন্যদের সঙ্গে মুস্তাফিজের একটা পার্থক্য ধরে ফেলেছেন বাংলাদেশের ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক, ‘একটা সময় স্টুয়ার্ট কার্পিনেনের সঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছে মুস্তাফিজ। একাডেমির এ ট্রেনারের সঙ্গে আমরা অনেকেই কাজ করেছি। কিন্তু মুস্তাফিজের মতো করে কাজটা হয়তো আমরা করিনি। দেখা গেল স্টুয়ার্টের কথামতো সবই করেছি, কিন্তু সেসবের পরে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেইনি। মুস্তাফিজ এটা কখনোই করে না। নিজেকে তৈরি রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ও সব সময় নেয়। ওকে দেখে আপনাদের কার কী মনে হয় জানি না, তবে ও ক্রিকেটটা খুব ভালো বোঝে। ব্যাটসম্যানকে তাড়াতাড়ি রিড করে ফেলতে পারে। এই স্মার্টনেসের তুলনা নেই।’
আইপিএলের দুনিয়ায় হোটেলরুমে বন্দি থাকার রেওয়াজ নেই। রাতে ক্রিকেট, গভীর রাতে পার্টিই রেওয়াজ। কিন্তু ম্যাচ আর প্র্যাকটিসের বাইরে যে যখন ফোন করেছেন মুস্তাফিজকে হোটেলরুমেই পেয়েছেন সবাই। গতকাল কালের কণ্ঠকে সাক্ষাত্কার দেওয়ার সময়ও রুমে মুস্তাফিজ, যা ক্লান্তি এবং চোটের আশঙ্কা দূর করার অব্যর্থ কৌশল বলেই মনে করেন মাশরাফি, ‘আইপিএলে কেন, সব সময়ই বিশ্রাম নেয় মুস্তাফিজ। ওকে দেখে মনে হয় জীবনে ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু নেই।’
তাই বলে এই সেদিনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা সাতক্ষীরার এক তরুণ ভিনদেশি আইপিএল এভাবে মাত করে দেবে? কাটার-স্লোয়ার-ইয়র্কারে বিভ্রান্ত ব্যাটসম্যান ফুলটস পেয়েও ধন্দে পড়ে যাবেন!
মাশরাফির কাছে এর ব্যাখ্যাও আছে, ‘মুস্তাফিজ এমন একজন বোলার, যার কাছ থেকে প্রতিটা বলেই নতুন কিছুর আশঙ্কা করে ব্যাটসম্যান। ভাবে, হয় স্লোয়ার নয়তো কাটার দেবে। ফুলটসের জন্য মোটেও তৈরি থাকে না। সার্বক্ষণিক একজন বোলার চাপে রাখলে যা হয় আর কি! আর ওই যে বললাম, ও ব্যাটসম্যানদের খুব দ্রুত বুঝে ফেলে।’
সে যত বড় বোলারই হোক না কেন, বয়সে তরুণ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও খুব বেশি দিন হয়নি। সেখানে ‘অচেনা’ আইপিএলের শুরু থেকেই নিজের ফিল্ডিং সাজানো থেকে শুরু করে ব্যাটসম্যানদের সম্মোহিত করে রাখা—সবই তো অবিশ্বাস্য রূপকথার মতো ঘটনা! সানরাইজার্স হায়দরাবাদের ম্যাচ রাতে দেখেন আর পরদিন অবিশ্বাস্য সেসব বিষয় নিয়েই চর্চা চলে দেশজুড়ে। মুস্তাফিজের ‘ভাই’ মাশরাফি কিংবা সাকিব আল হাসানও সোৎসাহে যোগ দেন সে চর্চায়।
মুস্তাফিজকে ঘিরে আরো বড় স্বপ্ন দেখেন সবাই, সঙ্গে উদ্বেগও তো আছে। কাল দুপুরে যেমন টেলিফোনে মুস্তাফিজকে জাতীয় দলের ম্যানেজার খালেদ মাহমুদের প্রথম প্রশ্নটাই ছিল, ‘কিরে, শরীর ভালো তো?’ প্রথমে কাঁধ এবং সাইড স্ট্রেইনের চোটে ভোগা মুস্তাফিজকে ঘিরে এ ভয় তাঁর সতীর্থদেরও। আইপিএল মানে একের পর এক ম্যাচই শুধু নয়, এ-রাজ্য ও-রাজ্য বিমানভ্রমণের ক্লান্তি আর দলের দাবি মেটাতে গিয়ে না আবার চোটে পড়েন মুস্তাফিজ! আর আইপিএলের প্রথমভাগেই যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তাতে নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের সব ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেই ডাক পড়বে তাঁর। টানা খেলে চোটজর্জরিত হবেন না তো মুস্তাফিজ?
আশার কথা, মুস্তাফিজ নিজেও নিজেকে ফিট রাখার ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজির বিরামহীন প্রলোভন কি তিনি ভুলে থাকতে পারবেন? একবার অবশ্য ‘ছাড়’ দিয়েছেন মুস্তাফিজ। পাকিস্তান প্রিমিয়ার লিগে লাহোর কালান্দার্স ৫০ হাজার ডলারে নিয়েছিল বাংলাদেশের বাঁহাতি এ পেসারকে। কিন্তু ‘জাতীয় স্বার্থে’ মুস্তাফিজকে সে আসরে খেলতে দেয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সে সময় বোর্ডের পক্ষ থেকে মুস্তাফিজকে ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার একটা আলোচনাও হয়েছিল। যদিও সে ক্ষতিপূরণ আর পাননি তিনি। তাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতিতে মুস্তাফিজকে ‘আটকে’ রাখা কঠিনও হতে পারে বোর্ডের জন্য। পেশাদার দুনিয়া যে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাঁকে!