গবেষণা বলছে, বর্তমান যুগের মানুষ আগের দিনের চেয়ে ২০% বেশি ক্যালোরি খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। যদিও মানুষের মধ্যে খাবার নিয়ে সচেতনতা আগে চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে, কিন্তু নিয়মানুসারে সব সময় স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া হয়ে ওঠে না। যেমন, ভুল সময়ে আপেল খেলে হজম শক্তি বাড়ানোর পরিবর্তে এটি পেটে গণ্ডগোল তৈরি করে। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হলো, কোন খাবার কখন খাওয়া উচিৎ তা মেনে চলা খুব কঠিন কোনো কাজ নয়। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণা এবং কোন খাবার কখন খেলে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যাবে তা আপনাদের জানানোর জন্য আমরা ব্যাকুল হয়ে আছি। আসুন জেনে নিই বিস্তারিত।  

ভাত

                          ভাত আমাদের প্রধান খাবার। সারাদিন শরীরে শক্তি ধরে রাখা কিংবা খিদে মেটাতে ভাতের উপরই আমাদের নির্ভর করতে হয়। ভাতের প্রায় পুরোটাই কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট, যা হজম হতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। এটা একদিকে ভালো এই জন্য যে, দীর্ঘক্ষণ দেহে শক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু রাতে ভাত খেলে আপনি মোটা হয়ে যাবেন। দুপুর হচ্ছে ভাত খাওয়ার সব চেয়ে ভালো সময়। এই সময় দেহের মেটাবোলিজম দ্রুত কাজ করে এবং ভাত হজম হতে সুবিধা হয়। পাশাপাশি সারাদিন কর্মক্ষম থাকতে ভাতের কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট বিশেষ ভূমিকা পালন করবে!  

চিনি

যদি স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে দীর্ঘজীবী হতে চান তাহলে চিনি থেকে দূরে থাকুন। কিন্তু রেস্টুরেন্ট বা প্যাকেটজাত বিভিন্ন খাবারের সাথে চিনি আমাদের দেহে কোন না কোন ভাবে ঢুকেই পড়ে। এতে রক্তের সুগার বেড়ে যায় এবং আপনাকে ক্লান্ত এবং নার্ভাস করে দেয়। যদি চিনিমুক্ত জীবন বেছে নিতে চান, তাহলে দোকানের খাবার এবং পানীয় থেকে দূরে থাকুন, মিষ্টি খাবার খাওয়াও একদম কমিয়ে দিন।  

দুধ

অনেকে ছোট বেলা থেকেই দুধ খেয়ে দিন শুরুতে অভ্যস্ত, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এটা একটি ভুল কাজ। দুধ সহজে হজম হয় না, তাই সকালে দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার খেলে বুক জ্বালাপোড়া এবং পেট ব্যথা তৈরি হতে পারে। ১ গ্লাস গরম দুধ খাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে সন্ধ্যা। এতে আপনার শরীর ঠাণ্ডা হবে এবং রাতে সুন্দর ঘুম নিশ্চিত করবে।  

মাংস

প্রোটিন এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের অসাধারণ উৎস মাংস, কিন্তু পরিপাক তন্ত্রের উপর এটি অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। তাই রাতে মাংস খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। কারণ শরীর যখন মাংস হজম করতে ব্যস্ত থাকে তখন আপনার মস্তিষ্ককেও সে জাগিয়ে রাখে, ফলে আপনার রাতের ঘুম হারাম। মাংস হতে হবে চর্বি ছাড়া, এবং তা দিনের বেলায় খাওয়াই উত্তম। তা না হলে রাতে এটি আপনাকে বেশ ভোগাবে এবং নিয়মিত রাতে মাংস খাওয়ার অভ্যাস ওজন বাড়িয়ে দেয়। মাংস খাওয়ার উপযুক্ত সময় রাতও নয়, সকালও নয়। দুপুরের খাবার হিসাবে মাংস খাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ এবং বুদ্ধিমানের কাজ। সকালে মাংস খেলে বদ হজম, এবং রাতে ঘুম নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।  

কলা

                            যদিও মনে হতে পারে সকালে কলা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী, কিন্তু খালি পেটে কলা খেলে শরীরের শক্তি হ্রাস পায়। খালি পেটে কলা খাওয়ার সাথে সাথে বেশ শক্তি অনুভব করলেও ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আবার আপনার খিদে লেগে যাবে। যাদের হজমে সমস্যা রয়েছে তাদের অনেকের ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। তাই যদি কলা খেতে ভীষণ ভালো লাগে তাহলে নাস্তায় অন্যান্য খাবারের সাথে কলা খেতে পারেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটযুক্ত খাবারের সাথে, যেমন পিনাট বাটারের সাথে।  

বাদাম

স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং ক্যালোরির চমৎকার উৎস হলো বাদাম, কিন্তু রাতে বাদাম খাওয়া বোকামি। আবার বেশি পরিমাণে বাদাম খাওয়াও ঠিক নয়। এতে হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা সৃষ্টি হয় এবং ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করে। হৃদস্বাস্থ্য ধরে রাখা, কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং ওজন কমানোর বা চুল ও ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বাদামের ভূমিকা থাকলেও তা অবশ্যই দিনের দুইটি খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে খাওয়া উত্তম। অর্থাৎ সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাওয়া, এই দুইয়ের মাঝামাঝি সময়ে খেতে হবে।  

পনির

পনিরযুক্ত কোনো খাবারই রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগে খাওয়া উচিৎ নয়, বরং সন্ধ্যার পর থেকেই এ জাতীয় খাবার খাওয়া বন্ধ করতে হবে। কারণ পনিরযুক্ত খাবার হজম হয় বেশ দেরিতে, এতে দীর্ঘক্ষণ পেট ব্যস্ত থাকে। ফলে, ঘুমের সমস্যা তৈরি হয়। তাই বিকাল বেলা পনিরযুক্ত খাবার খেতে পারেন। এতে ঘুমের সময় হওয়ার আগেই আপনার পেট এসব খাবার হজম করে ফেলবে। আবার সকালের নাস্তায় কিন্তু পনিরযুক্ত খাবার বেশ উপকারী। সারাদিন শক্তি যোগানোর পাশাপাশি দেহের ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ এবং মাংস পেশি এবং হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে।  

কফি

                                ঘুম থেকে উঠেই খালি কফি খাওয়া অনেকের দৃষ্টিতেই স্বাস্থ্যকর মনে হলেও এটি একদমই অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয়। গবেষণায় দেখা গেছে, খাওয়ার আগে কফি খেলে ক্যাফেইন টলারেন্স বৃদ্ধি পায়। ঘুম থেকে ওঠার প্রথম ঘণ্টায় আপনার দেহে কর্টিসোল উৎপাদন হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটানো একদমই উচিৎ নয়, কারণ এতে দেহের স্বাভাবিক কাজ কর্মের ছন্দপতন ঘটে। তাই কফি উপভোগের জন্য কিছুক্ষণ সময় অপেক্ষা করুন। তবে মনে রাখতে হবে প্রতিদিন শরীরের স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে ২/৩ কাপের বেশি কফি পান করা যাবে না এবং বিকালের পর একদমই নয়। এতে অনিদ্রা তৈরি হতে পারে।  

টক ফল

টক ফল বা ফলের রস খেলে শরীরের চর্বি কাটে এবং ওজন কমতে শুরু করে বলেই আমরা জানি। কিন্তু যাদের গ্যাসের সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটি হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ টক ফলে সাইট্রাস অ্যাসিড থাকায় এটি হজমজনিত বিভিন্ন সমস্যা যেমন, বুক জ্বালা, বদ হজম ইত্যাদি সৃষ্টি করে। তাই ভরা পেটে টক ফল খাওয়া যেতে পারে, কিন্তু রাতে অবশ্যই নয়।  

শিম

শিমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ, তাই রাতে শিম খেলে পেট ফুলে উঠতে পারে এবং ঘুমের সমস্যা তৈরি করে। তাই শিম খাওয়ায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। দুপুর বেলা শিম খাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়। এসময় দেহ কর্মব্যস্ত থাকে বলে এর সকল উপকারিতা শরীর গ্রহণ করতে পারে এবং সহজেই হজম হয়ে যায়। অন্যথায় আপনি শিম খেয়ে অস্বস্তিতে পড়বেন।  

আপেল

                            হজম শক্তি এবং কোলনের কার্যক্রম বাড়াতে আপেল অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ এবং প্রাকৃতিক না খনিজ উপাদান ও ভিটামিন। কিন্তু রাতে আপেল খেলে পেটে অসুবিধা সহ অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। অনেক সময় পেটে গ্যাসও তৈরি হয় এবং মল শক্ত করে দেয়। কারণ রাতে হজম শক্তি কমে যায় আমাদের এবং খাবার হজম হতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। তাই আপেল খাওয়ার মূল সময় হলো সকাল বেলা। দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে উঠে আপেল খাওয়ার মাধ্যমে আপনার হজম প্রক্রিয়া আবার সচল করে তুলতে পারেন। রাতের খাবারে যদি খুব বেশি অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে থাকেন তাহলে এটি ভালো কাজ দেবে।  

দই

খালি পেটে বা খাওয়ার আগে দই এড়িয়ে চলা ভালো। দইয়ে ল্যাকটিক অ্যাসিড থাকায় খালি পাকস্থলীর স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। এতে দই খাওয়ার পর যে খাবার খাবেন তা সহজে হজম নাও হতে পারে। কারণ খালি পেটে দই খেলে পাকস্থলীর হজম শক্তি হ্রাস পায়। আবার খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই দই খাওয়াও ঠিক নয়। খেতে হবে খাবার খাওয়ার অন্তত ১ ঘণ্টা পরে। এর ল্যাকটিক অ্যাসিড তখন পাকস্থলীকে খাবার হজমে সাহায্য করবে এবং দেহে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ ও মাংসপেশি সবল করে তোলে।   উপরে খাবারগুলো খাওয়ার যে নিয়ম কানুনগুলো উল্লেখ করা হয়েছে তার কোনটি মেনে চলতে আপনার বেগ পেতে হবে বলে মনে হচ্ছে? আমাদের মতে একটিও নয়। নিয়ম মেনে খাবার খেলে সেই খাবারের সর্বোচ্চ সুফল পাবেন, কিন্তু অনিয়মে কি হয় তা তো জেনেছেনই ইতোমধ্যে।