9 নজরুলের গানে ও কবিতায় অনেক রকম ফুল এসেছে নানা মাত্রায়। কখনো নারীর অলংকার, কখনো–বা উপমা হিসেবে। আগামীকাল ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী। কবি নজরুলের গান-কবিতায় থাকা ফুল নিয়ে নকশার বিশেষ আয়োজন। এই ফুলগুলো সাজসজ্জাতেও অনন্য। এ আয়োজনে নজরুলের কয়েকটি ফুল দিয়ে এই সময়ের মডেলকে সাজানো হয়েছে। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছেন: ‘আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,...’ অর্জুন,অশোক,বকুল,চামেলী,দোলনচাঁপা,গোলাপজাম,হাসনাহেনা,জুঁই,কদমকিন্তু তাঁর এই বিদ্রোহের আড়ালে আছে দরদমাখানো নরম-নিসর্গের আলাপচারিতা। নরম সৌন্দর্যের বর্ণনা। আছে নন্দনকানন থেকে পারিজাতকে পাওয়ার বাসনা। তাই তিনি বইয়ের নামকরণে বেছে নিয়েছেন অনবদ্য ফুলদল। দোলনচাঁপা, ঝিঙেফুল, ফণীমনসা, রাঙা-জবা, মহুয়া—আরও কত নাম। এসব পুষ্পসৌরভ তাঁর রচনাকে সুরভিত করেছে বারবার। তাঁর রচনাসম্ভারে নানাভাবে পুষ্প-বৃক্ষের প্রসঙ্গ এসেছে। কখনো উপমায়, কখনো সরাসরি। যেমন নার্গিস কখনো প্রিয়তমা, কখনো ফুল হিসেবে এসেছে। তিনি গেয়েছেন: ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে ঝরা বন-গোলাপের বিলাপ শোনে।...’ গোলাপ হাতে...নার্গিস মূলত ফুলের নাম। আমাদের দেশে গুলনার্গিস নামে একটি কন্দজ ফুল আছে। সেটি নজরুলের সেই নার্গিস নয় বলেই মনে করা হয়। তবে এই উপমহাদেশে নার্গিসের আগমন ও কদর সম্ভবত মোগলদের হাত ধরে, যা পৃথিবীজুড়ে নার্সিসাস নামেই বেশি পরিচিত। গভীর ভাবনা-বোধ থেকে কোনো নারীর পরনে কবি দেখেছেন কানে অর্জুনের ফুল আর গলায় কদম ফুলের মালা। ‘অর্জুন মঞ্জরী কর্ণে গলে নীপ-মালিকা...’ অর্জুনকে বলা হয় নিগৃহীত সুন্দর। ঔষধি গুণ থাকায় অর্জুনের বাকল তুলে নেওয়ার কারণে গাছটি শ্রীহীন হয়ে পড়ায় এমন নামকরণ। অর্জুনের ফল দেখতে কামরাঙার মতো। কবিতায় উল্লিখিত ‘নীপ’ মানে আমাদের বহুল পরিচিত কদম। বাংলার অবহেলিত বুনোফুলও তাঁর কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিনি ফুলকে মেখলা সাজিয়ে দেখতেই বেশি আনন্দ পান। বাবলা ফুলের নাকছাবি আর নীল অপরাজিতার শাড়ি তাই উপমায় মূর্ত হয়ে ওঠে। ‘বাবলা ফুলের নাকছাবি তার গায়ে শাড়ি নীল অপরাজিতার চলেছি সই অজানিতার উদাস পরশ পেতে।’ আবার খোঁপায় পরিয়েছেন অবহেলিত ধুতরা ফুল। ধুতরা ফুলের সৌন্দর্যও তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি গান বেঁধেছেন: ‘কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল লো। খোঁপা খুলে কেশ হ’ল বাউল লো।..’ কোনো এক অভিসারের পথে কবি তাঁর প্রিয়তমার জন্য পুষ্পার্ঘ্য কামনা করেছেন। তিনি চেয়েছেন তাঁর মানসপ্রিয়া হেঁটে আসুক পুষ্পবিছানো পথ ধরে। ‘দিও ফুলদল বিছায়ে পথে বধূর আমার কৃষ্ণচূড়ার সাথে রঙ্গন অশোকে, বুলাল রঙের মোহন তুলিকা লো..পায়ে পায়ে দলি ঝরা সে ফুলদল আজি তার অভিসার।’ লজ্জাবতী,মালতী,মহুয়া,নার্গিস বা নারসিসাস,নীল অপরাজিতা,পদ্ম,পারিজাত,পলাশ,স্বর্ণচাঁপাসাত ভাই চম্পার পারুল কিন্তু একটি দুর্লভ ফুলের নাম। এই বিখ্যাত এবং দুর্লভ ফুলটি নিয়ে তিনি কাব্য করেছেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর রচনায় পারুলের প্রসঙ্গ এনেছেন অনেকবার। বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি যুথী বেলি‘সাত ভাই চম্পা জাগোরে কেন বোন পারুল ডাকোরে’ নজরুল কিশোরী রাধার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেন: ‘তুমি অপরাজিতার সুনীল মাধুরী দু চোখ আনিলে করিয়া কি চুরি? তোমার নাগকেশরের ফণী- ঘেরা মউ পান করাল কে কিশোরী?’ এখানে নজরুল অপরাজিতা এবং নাগেশ্বরের কথা বলেছেন। নীল, সাদা এবং বেগুনি রঙের অপরাজিতা মূলত বর্ষজীবী লতানো গাছ। এর মধ্যে নীল অপরাজিতাই বিখ্যাত। আর নাগেশ্বর এই অঞ্চলের প্রাচীন ফুল। আমাদের কাব্য-কলা-উপমায় এর প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। খানিক স্পর্শে নুয়ে পড়া লজ্জাবতীও কবির দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি লিখেছেন: ‘লজ্জাবতীর লুলিত লতায় শিহর লাগে পুলক-ব্যথায় মালিকা সম বঁধূরে জড়ায় বালিকা-বধূ সুখ-স্বপনে’ নজরুল অসংখ্য গানে পুষ্প-বৃক্ষের কথা বলেছেন। বলেছেন তাদের রূপ-মাধুরীর কথা। তিনি গেয়েছেন: ‘পরো কুন্তলে, ধরো অঞ্চলে অমলিন প্রেম-পারিজাত।’ এই পারিজাত মানে মান্দার। স্বর্গীয় ফুল। অন্যত্র তারই ব্যবহার লক্ষ করা যায়: ‘আনো নন্দন হতে পারিজাত কেশর তীর্থ-সলিল আনো ভরি’ মঙ্গল-হেম-ঝারি।...’ অশোকের বর্ণাঢ্য রঙের কথা পাওয়া যাবে এখানে: ‘অশোক ফুটেছে যেন পুঞ্জে পুঞ্জে রং পিয়াসী মন-ভ্রমর গুঞ্জে, ঢালো আরো ঢালো রং প্রেম-যমুনাতে।’ রঙ্গন ফুলও এসেছে চমৎকারভাবে— কৃষ্ণচূড়ার সাথে রঙ্গন অশোকে বুলাল রঙের মোহন তুলিকা লো..। শাড়ি: যাত্রা, সাজ: মিউনিস ব্রাইডালনজরুল তাঁর লেখনীতে তুলে এনেছেন আমাদের চারপাশের সমস্ত চেনা ফুল, যেসব ফুলের সঙ্গে আমাদের প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়। যেমন চামেলি, জুঁই, শিউলি, চাঁপা, মালতী, টগর, বকুল, বেলি, শাপলা, পদ্ম, বঁইচি, পলাশ, কেয়া, হাসনাহেনা ইত্যাদি। ‘বনে মোর ফুটেছে হেনা চামেলি যুথী বেলি।’ এই চেনা ফুলগুলোর আবেদন যেমন চিরন্তন, তেমনি এ যুগের সাজে, এই সময়ে তরুণীদের পছন্দের সঙ্গে মানিয়েও যায় বেশ ভালোভাবে।