রাতের নীরবতা ভেঙে একটানা বা থেমে থেমে বিচিত্র স্বরে বিচিত্র লয়ে সে ডেকে যাচ্ছে। শব্দ কখনো বাড়ছে কখনো কমছে। কারও নাক ডাকছে। পাশের ঘরে হলে না হয় দরজা-জানালা বন্ধ করে, হালকা শব্দে গান ছেড়ে কোনো না-কোনোভাবে বাঁচলেন।
কিন্তু নাক ডাকেন এমন কারও সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতে হলে! হায় হায় রাতের ঘুমের একেবারে দফারফা! এ তো গেল যে শুনছে তাঁর অবস্থা। কিন্তু যিনি নাক ডাকেন, তাঁর কী হাল?
চিকিত্সকেরা বলছেন, নাক ডাকা অন্য অনেক স্বাস্থ্যসমস্যার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ এমনকি স্ট্রোকের ঝুঁকির আলামতও হতে পারে। লন্ডনের দ্য প্রাইভেট ক্লিনিকের নাক-কান-গলারোগ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিত্সক নাক ডাকার নয়টি কারণ ও এর প্রতিকার সম্পর্কে জানিয়েছেন।
অ্যালকোহলকে না বলুন:
বেশি পরিমাণে অ্যালকোহল বা মদ-জাতীয় পানীয় পানের কারণে কারও নাক ডাকতে পারে। অ্যালকোহল জিভের পেশিগুলোকে শিথিল করে দেওয়ার কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের নালি সংকুচিত হয়ে পড়ে আর এ থেকে নাক ডাকা শুরু হয়। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অ্যালকোহল পান থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করার চেষ্টা চালানো যেতে পারে।
ধূমপান ছাড়তে হবে:
ধূমপানের কারণে এমনিতেই শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত কিছু জটিলতা তৈরি হয়। আবার ধূমপান থেকে টারবাইনেটস নামে নাকের বিশেষ এক ধরনের টিস্যু স্ফীত হয়ে যেতে পারে এবং এ থেকেও শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ধূমপানের এই দুই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেই নাক ডাকার সমস্যা হতে পারে। ধূমপানের বদ-অভ্যাস ত্যাগ করতে পারলে আপনার আর আপনার সঙ্গীর রাতের ঘুমই শুধু ভালো হবে না, তা আপনার সার্বিক স্বাস্থ্যের নাটকীয় উন্নতিতে সহায়ক হবে।
মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন:
অতিরিক্ত পরিমাণে মসলাযুক্ত খাবার খেলে পাকস্থলীতে বেশি মাত্রায় অ্যাসিডের প্রতিক্রিয়া শুরু হতে পারে। অনেক গবেষণা থেকেই দেখা গেছে, এজাতীয় সমস্যার সঙ্গে নাক ডাকার সম্পর্ক আছে। যদি কিছুতেই নাক ডাকার কারণ খুঁজে বের করতে না পারেন, তাহলে খাবারদাবারে মসলার পরিমাণ কমিয়ে বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কি।
অতিরিক্ত ওজন কমান:
অতিরিক্ত ওজন নাক ডাকার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলোর একটা। আপনার ওজন যত বেশি হবে, নাক ডাকার আশঙ্কাও তত বেশি বাড়তে থাকবে। আর অতিরিক্ত মুটিয়ে মানুষের নাক ডাকার শব্দও কিন্তু বেশি। ওজন কমানোর চেষ্টা করেন। কয়েক কিলোগ্রাম ওজন কমাতে পারলেও হয়তো নাক ডাকা না-ডাকার বিষয়টা আপনার কাছে স্পষ্ট হতে পারে।
শোয়ার ভঙ্গি বদলান:
যাঁদের নাক ডাকে, তাঁরা চিত্ হয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে শোয়ার অভ্যাসটা বাদ দিয়ে দিতে পারেন। আর যদি চিত্-কাত হতে হতে আর সঙ্গীর খোঁচা খেতে খেতে বিব্রত হয়ে থাকেন, তাহলে সঙ্গীর দিকে পিঠ দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন। আপনার পাজামায় কোমরের কাছে একটা টেনিস বল গুঁজে রাখলে আপনা-আপনি চিত্ হয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পেয়ে যেতে পারেন। এতে নাক ডাকাও কমতে বা বন্ধ হতে পারে।
বিছানা পরিষ্কার রাখুন:
বিছানাপত্রে বেশি ধুলাবালি থাকলে, ঘর বেশি ময়লা হলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়। এ পরিস্থিতিতে নাকের নালিতে ধুলা-ময়লা সংক্রমিত হয়ে নাকের পেশি ফুলে উঠতে পারে এবং নাক ডাকা শুরু হতে পারে। তাই বিছানাপত্র ও ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাটা খুবই জরুরি। এটাই স্বাস্থ্যসম্মত এবং এতে ঘুমও ভালো হয়। আর নাক ডাকাও দূর হতে পারে।
জৈবিক কারণ খুঁজুন:
চিকিত্সাবিজ্ঞান অনুসারে নাক ডাকার তিনটি প্রধান জৈবিক কারণ আছে। নাকের নালিতে পুরু নরম প্রলেপ থাকা, অন্য কোনো কারণে নাকের নালি আংশিক সংকুচিত থাকা এবং জিহ্বার পেছনে বায়ুপথ সংকুচিত থাকা। আসল কারণ খুঁজে বের করতে না পারলে এ থেকে নিস্তার পাবেন না। একজন সাধারণ চিকিত্সক যদি এ বিষয়ে সাহায্য করতে না পারেন, তাহলে নাক-কান-গলারোগ বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে পরামর্শ নিন।
নাক না গলা জেনে নিন:
আপনি নাক দিয়ে শব্দটা করছেন, নাকি গলা দিয়ে—সেটা আগে নিশ্চিত হওয়া জরুরি। অনেকের ক্ষেত্রে আবার দুটাই একসঙ্গে হতে পারে। তবে নাক বা গলার যেকোনো একটায় সমস্যা থাকলে নিশ্চিন্তে আপনি নাকের ড্রপ বা গলার স্প্রে—যেকোনো একটা বাদ দিয়ে দিতে পারেন।
স্থায়ী সমাধান:
নানা ধরনের বুদ্ধি-পরামর্শ চেষ্টা করে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে থাকলে কিংবা এ নিয়ে বিব্রত হতে হতে বিষয়টা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে থাকলে এবার স্থায়ী সমাধানের দিকে এগোন। একজন নাক-কান-গলারোগ সার্জনের কাছে যান। এখন লেজার রশ্মির মাধ্যমে নাকের ও জিহ্বার পেছনের শ্বাসনালির সংকুচিত অবস্থা দূর করার চিকিত্সা সম্ভব। স্থানীয়ভাবে চেতনানাশক ব্যবহার করে এ অপারেশন খুব বেশি সময়সাপেক্ষও নয়। তবে অবশ্যই তা হতে হবে দক্ষ অস্ত্রোপচার বিশেষজ্ঞের অধীনে।
ম্যাড বা ম্যান্ডিবুলার এ্যাডভান্সমেন্ট ডিভাইস:
এই যন্ত্রটি কোনরকম কোন বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই আপনার নীচের অংশের চোয়ালকে সামনের দিকে টেনে ধরে রাখে ঘুমের সময়। ফলে আপনার উপরের অংশের চোয়াল যথেষ্ট বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ পায় আর শ্বাস নিতে কোনরকম সমস্যার উদ্ভব হয়না। যখন শ্বাস নেওয়ার সময় কোন সমস্যা তৈরি হয়না ( যেটি কিনা নাক ডাকার অন্যতম কারণ ), তখন নাক ডাকার মতন সমস্যার সৃষ্টি হওয়ারও প্রশ্ন আসেনা।
নাকের স্প্রে:
আপনার যদি নাক ডাকার সমস্যাটি ঠান্ডার সাথে যুক্ত কোন বিষয় হয়ে থাকে তাহলে নাকের শ্বাস নেওয়ার স্থানটিকে পরিষ্কার রাখুন। এজন্যে ঘরে তৈরি নাকের স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন। স্প্রে তৈরি করতে এক কাপ বিশুদ্ধ পানির সাথে দুই টেবিল চামচ কশের লবন মেশান। এবার সেটাকে নাকে স্প্রে করুন। সর্দি দূর হবে। দূর হবে নাক ডাকার সমস্যাও।
জিব আর গলার ব্যায়াম:
জিবের ব্যায়াম করার জন্যে বেশকিছু যন্ত্রের সাহায্য পেতে পারেন আপনি। বাজারে এগুলো কিনতে পাওয়া যায়। তবে গলার ব্যায়াম করতে-
ক. ইংরেজি অক্ষরগুলো জোরে জোরে উচ্চারণ করুন
খ. চোয়ালকে আধ মিনিট করে ডানে ও বামে বাঁকান।
গ. সামনের দাঁতের পেছন দিক দিয়ে জিবের সাহায্যে সেটাকে ঠেলুন।
এভাবে আপনার জিব আর গলা সুঠাম হবে এবং নিয়মিত এই ব্যায়ামগুলো করার মাধ্যমে নাক ডাকার সমস্যার হাত থেকেও মুক্তি পাবেন আপনি।