বিশ্বজুড়ে অকালমৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো হৃদ্রোগ। চলমান জীবনকে হঠাৎ থামিয়ে দেয় এই রোগ। রোগটি এমন সন্তর্পণে জীবনে প্রবেশ করে যে টেরও পাওয়া যায় না। কিন্তু আপনিই এই হার্টকে সুস্থ রাখতে পারেন। ভালো থাকা আসলে আপনারই হাতে।
হার্টকে সুস্থ ও সজীব রাখতে ৮টি অভ্যাস আপনাকে জিতিয়ে দিতে পারে, এমনটাই বলছেন গবেষকেরা।
নিজেকে জানুন
ব্যস্ত দিনগুলোতে নিজেকে জানার সুযোগ হয় না আমাদের। কিন্তু এই অজ্ঞতার ফাঁকফোকর দিয়েই ঢুকে পড়ে রোগবালাই। বেশির ভাগ হৃদ্রোগ নীরব ঘাতক। কিন্তু ঝুঁকিগুলো জানা থাকলে সতর্ক হওয়া যায়। তাই নিজেকে জানুন। নিজের রক্তচাপ মাঝেমধ্যে মাপুন। আপনার রক্তে শর্করা, চর্বির পরিমাণ কেমন তা বছরে একবার অন্তত জানার চেষ্টা করুন। এমনকি ওজন বাড়ছে না কমছে, উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক আছে কি না, খেয়াল করুন। লক্ষ করুন আপনার পরিবারে মা-বাবা, আপন ভাইবোনদেরও হৃদ্রোগ দেখা দিয়েছে কি না।
খাদ্যাভ্যাসে খেয়াল রাখুন
কেবল নিজেকে নয়, পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুস্থ থাকা জরুরি। তাই বাড়ির খাদ্যাভ্যাসে অন্তত পাঁচ পদের তাজা ফলমূল-শাকসবজি রাখুন প্রতিদিন। প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। লবণ খাওয়া কমান। চিনিযুক্ত পানীয়ও ধীরে ধীরে কমিয়ে দিন, পিপাসা মেটাতে ঘরে-বাইরে সাধারণ পানিই বেছে নিন।
বাদ দিন মন্দ অভ্যাস
ধূমপানকে চিরতরে না বলে দিন। হার্ট সুস্থ রাখতে এটা সবচেয়ে জোরালো পদক্ষেপ। সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার দুই বছর পর হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। আর ১৫ বছর পর আপনার ঝুঁকি একজন অধূমপায়ীর সমান হয়ে যায়। পরোক্ষ ধূমপান আপনার সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে এটাও খেয়াল করবেন।
বিশ্রাম নিন
দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে পরিমিত বিশ্রাম নিন। মানে, স্রেফ কিছুই করবেন না, কোনো চাপ নেওয়ার দরকার নেই। পূর্ণমাত্রায় বিশ্রাম হৃৎপিণ্ডের জন্য উপকারী। আর তাই মাঝেমধ্যে কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ান। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করুন। সাংসারিক কিংবা অফিসের কাজ ভুলে যান। স্রেফ নিজের জন্য বিশ্রাম নিন। সেটা শুয়ে-বসে যেকোনোভাবে। বিশ্রাম নেওয়ার পর দেখবেন ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। মানে, ওই বিশ্রামের সময়টুকু আপনাকে কাজের জন্য উজ্জীবিত করে তুলবে।
ওজনকে বশ মানান
স্থূলকায় মানুষের ওজন নিয়ে দুর্ভাবনার শেষ নেই। ওজন কমাতে ক্যালরির হিসাব করছেন, ব্যায়াম করছেন কিন্তু তারপরও কমছে না কিছুতেই। একটু মাথা খাটান। আপনি কি স্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন? স্বাস্থ্যকর খাবার আর ক্যালরিযুক্ত খাবার কিন্তু এক নয়। পুষ্টিকর খাবার খান এবং ক্যালরি খরচ ও গ্রহণে ভারসাম্য আনুন। তরল খাবার খেতে পারেন। শাকসবজি থাকুক প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। এ ছাড়া শারীরিক পরিশ্রম করুন। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা বাধ্যতামূলক করুন। লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। বাসা থেকে বের হয়েই রিকশা না নিয়ে হেঁটে কিছুটা পথ এগোন। বাসায় ফেরার পথেও একই কৌশল অনুসরণ করুন।
ধূমপান ছাড়ার চ্যালেঞ্জ জিতুন
ধূমপানের অপকারিতা সমন্ধে আমরা সবাই জানি। এ বদভ্যাসটি ছাড়ার নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। যে যার মতো করে চেষ্টা করে থাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ, পরিবারের সাহায্য কিংবা এ দুটি ব্যাপার মিলিয়ে চেষ্টা করলে সুফল পেতে পারেন। ধূমপানের অপকারী দিকগুলো নিয়ে ভাবুন। এটা ছাড়ার উপকারী দিকগুলোতে মনোযোগী হতে পারেন। ধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করাই শ্রেয়। মদ্যপান এড়িয়ে চলুন। এটা ধূমপানে আপনাকে আরও আকৃষ্ট করবে। শরীরচর্চার মধ্যে থাকলে ধূমপানের ইচ্ছা কমে যেতে পারে। কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যে থাকলেও সুফল পেতে পারেন।
ইতিবাচক মনোভাব ও চাপ কমান
হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে মানসিক প্রশান্তির বিকল্প নেই। কিন্তু কর্মক্ষেত্র, সমাজ কিংবা পরিবার থেকে মানুষ নানাভাবে চাপে থাকে। এসব চাপ যেমন মোকাবিলা করতে হবে, তেমনি বুদ্ধি করে কমাতেও হবে। প্রতিদিনের কাজের চাপ শেষে নিজের জন্য আলাদা করে একটু সময় বের করুন। পছন্দের গান শুনতে পারেন কিংবা বই পড়তে পারেন। কোনো কারণে মনে কষ্ট পেলে তা বন্ধু কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে ভাগ করে নিন। মনে কষ্ট পুষে রাখবেন না। এ ধরনের অভ্যাস হৃদ্রোগ ডেকে আনে। সবচেয়ে ভালো হয় পরিবার কিংবা কর্মক্ষেত্রে চমৎকার সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলা।
বেরিয়ে পড়ুন
সচল থাকুন। প্রতিদিন আধা ঘণ্টা বা সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি মানের ব্যায়াম; যেমন: হাঁটা, সাইকেল চালনা, সাঁতার ইত্যাদি হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে দেবে। দৈনন্দিন জীবনে ক্রিয়াশীলতা বাড়ান। যেমন: গাড়ি বাদ দিয়ে হাঁটুন, লিফট ছেড়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, ঘরের কাজ করুন, বাগানে কাজ করুন, সন্তানদের নিয়ে খেলাধুলা করুন।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৮০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ একাকিত্ব বোধ করেন এখনকার মানুষ। অর্থাৎ ১৯৮০ সালে এ হার ছিল ২০ শতাংশ, এখন ৪০ শতাংশ। একাকিত্ব শুধু মানসিক ক্ষতি করে না, শারীরিক ক্ষতিও করে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, কেউ যখন কারও সঙ্গে কথা বলে, তখন হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে মস্তিষ্ক হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। এতে হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম দারুণ সচল হয়ে ওঠে। অর্থাৎ হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতে মানসিক চাপ কমানো এবং চারপাশের মানুষের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তোলাও জরুরি।
ডা. শরদিন্দু শেখর রায়
হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল