ghyl দুটি দলেরই অবস্থান বিশ্ব ফুটবলে সফলতম দলগুলোর মধ্যে ওপরের সারিতে। কী সাফল্য, কী ঐতিহ্য—ফুটবল মাঠে ফ্রান্স ও জার্মানি মুখোমুখি হলেই ফুটবলের অনেক স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচের ইতিহাস সামনে চলে আসে। আজ মার্শেইতে ইউরোর সেমিফাইনালে দল দুটি মুখোমুখি হওয়ার আগেও যেমন আসছে। তবে ইতিহাসের সব পাতাই যে সুন্দর স্মৃতি নিয়ে আসছে তা নয়। উঠে আসছে কিছু ভুলে যাওয়ার মতো স্মৃতিও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুঃসহ স্মৃতিটি সম্ভবত বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সবচেয়ে বাজে। জুলাই ৮, ১৯৮২। সেভিয়া। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্স ও জার্মানির ম্যাচটি। ম্যাচজুড়ে নাটকীয়তা, অতিরিক্ত সময়ের চার গোলে ম্যাচে ৩-৩ সমতা; এরপর বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম টাইব্রেকারে জিতে ফাইনালে যায় জার্মানি। ফ্রান্সের সেই দলটির অধিনায়ক মিশেল প্লাতিনির চোখে, ‘বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ম্যাচ’ এটি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়েও ওই ম্যাচের আলোচনায় অবধারিতভাবে উঠে আসে ফ্রান্সের প্যাট্রিক বাতিস্তনের ওপর জার্মান গোলকিপার হারাল্ড ‘টনি’ শুমাখারের করা ট্যাকলটি। দাঁত ভেঙেছে তিনটি। পাঁজরের হাঁড়ে চিড় ধরেছে। আঘাত লেগেছে মেরুদন্ডের কশেরুকাতেও। কোমায় চলে যেতে হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত লোকটিকে। সাধারণত গাড়ি দুর্ঘটনায় এমন অবস্থা হতে পারে। তবে এসব কিছু হয়েছে ফুটবল মাঠে, বাতিস্তনের ওপর শুমাখারের ওই ফাউলে। ম্যাচে তখন ১-১ সমতা। মিশেল প্লাতিনির কাছ থেকে উড়ে আসা পাস ধরতে গিয়ে জার্মান রক্ষণকে পেরিয়ে গিয়েছিলেন বাতিস্তন। মাত্র মিনিট দশেক আগেই বদলি হিসেবে মাঠে নামা ফেঞ্চ ডিফেন্ডারকে এগিয়ে আসতে দেখে গোললাইন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন শুমাখার। বাতিস্তনও গোলকিপারকে কাছাকাছি দেখতে পেয়ে শট নিয়ে নেন। দুর্বল শটটি গড়িয়ে চলে যায় গোলপোস্টের বাইরে। টিভি ক্যামেরা, ও রেফারির চোখ, বলের দিকেই ছিল। না হলে ওদিকে মাঠে যে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম বাজে সংঘর্ষ ঘটে গেছে, সেটি টের পেতে এত দেরি হবে কেন! লাফাতে থাকা বলটা ধরতে এসে শুমাখার এমনভাবে লাফিয়ে উঠেছিলেন, তাঁর ঊরু গিয়ে লাগল বাতিস্তনের মুখে, পা লাগল পাঁজরে। এরপরের দৃশ্যটা হয়তো এখনো দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় সেভিয়ার মাঠে উপস্থিত দর্শকদের কাছে—বাতিস্তন লুটিয়ে পড়ে আছেন, হাত উঁচিয়ে সাহায্য চাইছেন। সতীর্থরাও দৌড়ে এসে ঘিরে ধরলেন তাঁকে, সাইডবেঞ্চে বসা ডাক্তারদের ডাকছেন। বাতিস্তনের জীবন নিয়েই তখন সংশয়। প্লাতিনিও পরে ঘটনাটার বর্ণনায় বলেছিলেন, ‘ওর পালস পাওয়া যাচ্ছিল না। মুখটাও ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।’ সাত মিনিট পর স্ট্রেচারে করে যখন বাতিস্তনকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, একটা হাত স্ট্রেচার থেকে বেরিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। কতটা দুর্বিষহ ছিল ট্যাকলটা, তারই যেন প্রমাণ হয়ে রইল ওই দৃশ্য। প্লাতিনি দৌড়ে গিয়ে বাতিস্তনের হাতটা উঠিয়ে ধরলেন, জড়িয়ে ধরেও চুমুও দিচ্ছিলেন হাতটাতে বারবার। তাতেও যদি প্রাণ ফেরে আপাত প্রাণহীন হাতটাতে! ওদিকে শুমাখার? ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন নিজের বক্সের কোণে। ফ্রান্সের খেলোয়াড়েরা, মাঠের দর্শকেরা যেখানে ঘটনার স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি, শুমাখার বলটাকে বসিয়ে রেখেছেন ছোট ৬ গজী বক্সের কোণে। হাত কোমরে, যেন খেলা শুরু করতে দেরি হওয়ায় আরও বিরক্ত। ওহ, বলাই হয়নি, রেফারি চার্লস করভার পুরো ঘটনাটার কিছুই দেখেননি। এ কারণে বিশ্বকাপ ইতিহাসের জঘন্যতম ট্যাকলটার ফল কী হলো—কোনো কার্ড নয়, ফ্রি কিক নয়; বরং জার্মানির পক্ষে গেল গোলকিক! অবশ্য ডাচ রেফারি পরে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমি সংঘর্ষটা দেখিনি। আমার চোখ বলের দিকে ছিল। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সহকারী রেফারিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, আঘাতটা ইচ্ছাকৃত ছিল না।’ ওই ঘটনায় স্তব্ধ ফ্রান্সের খেলোয়াড়েরা ম্যাচে আর ঠিকভাবে মনোযোগই দিতে পারেননি। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলের সমতার পর অতিরিক্ত সময়ে অবশ্য একটা সময়ে ৩-১ গোলে এগিয়েও গিয়েছিলেন প্লাতিনিরা। কিন্তু জার্মানি দুর্দান্তভাবে ফিরে এসে স্কোরলাইন ৩-৩ করে ফেলে। ফ্রান্সের জন্য আরও দুঃসহ ব্যাপার, টাইব্রেকারে দুটি শট ঠেকিয়ে দিয়ে জার্মানির নায়ক বনে গিয়েছিলেন গোলকিপার শুমাখারই। কিন্তু তাতে কী! পুরো বিশ্বই যেন সেদিন চেয়েছিল জার্মানির হার। ওই ম্যাচের পর শুমাখার যেন পরিণত হয়েছিলেন ফ্রান্সের জাতীয় শত্রুতে। এমনকি বিশ্বকাপের পর এক জরিপে নাকি অ্যাডলফ হিটলারের চেয়েও ফ্রান্সে বেশি ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে উঠে এসেছিল শুমাখারের নাম। জার্মান গোলকিপার পরে নিজেই বলেছিলেন, ‘এত ঘৃণা এর আগে কখনো অনুভব করিনি।’ যদিও শুমাখার সব সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এসেছেন। পরে নিজের পক্ষে দাবিও করেছিলেন, ‘আমি ওকে আঘাত দিতে চাইনি। তবে যদি এমন কিছু আবারও হয়, আমি হয়তো আবারও একই কাজ করব। বল ছিনিয়ে নেওয়ার এটাই ছিল একমাত্র উপায়।’ তবে ভয় যে কিছুটা হয়নি, তা-ও নয়, ‘আমার ভয় হচ্ছিল, বাতিস্তন খুব গুরুতর আঘাত পেয়েছে। মনে হচ্ছিল ও কোমায় চলে গেছে।’ কোমায় সত্যিই গিয়েছিলেন বাতিস্তন। প্রায় সাত মাস লেগেছিল সুস্থ হতে। এ জন্য ফ্রান্স কখনো ক্ষমা করেনি শুমাখারকে। যদিও পরে বাতিস্তনের বিয়ের আগের দিনে গিয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে এসেছিলেন শুমাখার। কিন্তু তাতে কী! ওই ম্যাচের দুই বছর পর ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে প্রীতি ম্যাচে দুই দল মুখোমুখি হয়েছিল। ফ্রান্স সমর্থকেরা সেই ম্যাচে হাতের কাছে যা পেয়েছিল, ছুড়ে মেরেছিল শুমাখারের দিকে। দুয়ো দেওয়া তো তখন নস্যি। শুমাখারও সেই ম্যাচের স্মৃতি হাতড়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপের পর ফ্রান্সের সঙ্গে আমাদের প্রথম ম্যাচ ছিল সেটি। যখন মাঠে ঢুকলাম, নিজেকে মনে হচ্ছিল যেন ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো পুতুল। পিচের চারপাশ থেকে ঘেরা ছিল, পুলিশও ছিল। তা না হলে ফ্রেঞ্চ সমর্থকেরা আমাকে ছিড়েই ফেলত। ডিম, আলু, আপেল, টমেটো, পাথর—কী মারেনি ওরা আমার দিকে! তবে আমি ছোট হইনি।’ পরে অবশ্য ফ্রান্স সমর্থকদের রাগ কমে গেছে। বিশেষ করে ২০১২ সালে, যখন বাতিস্তন নিজেই ঘোষণা করলেন, ‘আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’ কিন্তু তবু ফ্রান্স-জার্মানি ম্যাচের প্রসঙ্গ এলেই ওই ঘটনাটা বারবার ফিরে আসে। সূত্র: গোলডটকম।