rubel-ho-thereport24 প্রশ্ন : শুনেছি আপনি যে গতিতে মোটরসাইকেল চালাতেন, আপনার বোলিংয়ের গতিও এর প্রায় কাছাকাছিই! রুবেল হোসেন : (হাসি...) ঠিকই শুনেছেন। একসময় সত্যিই খুব জোরে বাইক চালাতাম। বাগেরহাটে একবার সর্বোচ্চ গতি তুলেছিলাম ১৩৮ কিলোমিটার! তবে ছোটখাটো কয়েকটি দুর্ঘটনায় শিক্ষা হয়ে গেছে। বুঝেছি বাইক দুর্ঘটনার চেয়ে বিশ্রী দুর্ঘটনা আর হয় না। তাই এখন খুব আস্তে আস্তে চালাই। প্রশ্ন : আপনার ক্যারিয়ারে ইনজুরি নামের দুর্ঘটনাও আছে বহুবার। কখনো কি মনে হয়েছে এবার বোলিংটাও আস্তে আস্তে...। রুবেল : প্রশ্নই আসে না। আমার বোলিংয়ে গতি সেই আগের মতোই আছে। সেই গতি আমি আরো বাড়াতে চাইও। কারণ আমি তো চাইবই যে বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার হিসেবে আমার নামটিই আসুক। প্রশ্ন : তাসকিন আহমেদও আরো জোরে বোলিং করতে চান। তা গতি নিয়ে আপনাদের দুজনের মধ্যে কি আলাপ হয়? রুবেল : ওকে দেখলেই আমি ‘হাই ফাস্টেস্ট’ বলে ডাকি। আর ও জবাবটা দেয় এরকম, ‘না, না, আমি না, আপনি।’ জোরে বল করার প্রতিযোগিতা থাকলে অবশ্য ভালোই। বাংলাদেশের এরকম বোলার আরো দরকার। আমি চাই নতুন নতুন ছেলেরা আসুক। যেমন রবি পেসার হান্ট থেকে এবাদত নামের একটি ছেলে উঠে এসেছে, যে কিনা ভীষণ জোরে বোলিং করে। প্রশ্ন : ইনজুরির কারণে দীর্ঘ বিরতির পর সদ্যসমাপ্ত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ দিয়েই মাঠে ফিরলেন। নিজের অবস্থা কী বুঝলেন? রুবেল : বেশ ভালো। ইনজুরি থেকে উঠেই ১৫টি ম্যাচ খেলা কম কথা নয়। একটি ম্যাচ শুধু ছোট্ট এক ইনজুরির জন্য খেলতে পারিনি। অনেক দিন পর ফেরায় প্রিমিয়ার লিগটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জেরও ছিল। জাতীয় দল থেকে যারা বাদ পড়ে কিংবা যাদের পারফরম্যান্স অনুজ্জ্বল এবং তরুণ ক্রিকেটার, সবার জন্যই এই আসরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে আমি ছন্দটা ধরতেও পেরেছি। যদিও ১৫ ম্যাচে ১৯ পাওয়াটা খুব বড় কিছু নয়। দিনের শেষে মানুষ যেহেতু উইকেটই গোনে, তাই এটা হয়তো চোখে লাগার মতো কিছু নয়। তবে ইকোনমি বেশ ভালো ছিল আমার। সেই সঙ্গে যেভাবে বোলিং করেছি, তাতে আমি নিজে অন্তত সন্তুষ্ট। প্রশ্ন : একটু আগেই বলছিলেন বোলিংয়ে গতি সেই আগের মতোই আছে। স্পিডগান ছাড়া এত সুনিশ্চিত হলেন কী করে? রুবেল : আন্তর্জাতিক ম্যাচ তো আর কম খেলিনি। কাজেই কোন বলের কত স্পিড উঠতে পারে, তা আমার ভালোই জানা আছে। প্রিমিয়ার লিগে বল রিলিজ করার পরই বুঝতে পারতাম যে গতি কেমন হয়েছে। একটা ‘এফোর্ট’ বল করলাম হয়তো, করার পরই বুঝি এটার গতি উঠেছে ১৪৩ কিলোমিটার। বলতে পারেন আমার মাথায় স্বয়ংক্রিয় একটা স্পিডগান আছে (হাসি...)। প্রশ্ন : বাংলাদেশ দলের বোলিংকে তো এখন দুই ভাগে ভাগ করে ফেলা যাচ্ছে। ‘বিফোর মুস্তাফিজ’ এবং ‘আফটার মুস্তাফিজ’। আপনি একমত? রুবেল : কেন নয়? মুস্তাফিজ আসার আগে যে বাংলাদেশের পেস বোলিং খারাপ ছিল, তা নয়। তবে ও আসার পরে দলের বোলিংয়ের চেহারাটাই কিন্তু পাল্টে গেছে। প্রশ্ন : মুস্তাফিজ কী এমন যোগ করেছেন যে এভাবে বদলে গেল? রুবেল : বাড়তি একটা কিছু তো অবশ্যই যোগ করেছে। আগে কিন্তু পেস বোলারদের ওপর বাংলাদেশ দল নির্ভরশীল ছিল না। এখন মানুষ ওদের কাছে আশা করে। কারণ মুস্তাফিজ আসার পরে এই ডিপার্টমেন্টটি আরো শক্তিশালী হয়েছে। প্রশ্ন : মুস্তাফিজের কারণে অন্য পেসারদের মধ্যেও নিশ্চয়ই কিছু পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনগুলো কী কী? রুবেল : বুঝতে পারছি আপনি কোন পরিবর্তনের কথা বলতে চাচ্ছেন। মুস্তাফিজ আসার ফলে দলে আমার জায়গা পাওয়া আরো কঠিন হয়ে গেছে, এরকম কোনো কিছু কি? প্রশ্ন : ইতিবাচক অর্থেই জানতে চাচ্ছি প্রতিযোগিতা আগের চেয়ে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে কি না? রুবেল : তা তো অবশ্যই। বাংলাদেশ দলে এখন প্রতিটা জায়গাই চ্যালেঞ্জিং। এটা আমাদের জন্য যেমন, তেমনি দলের জন্যও ভালো। কারণ এতে করে দল আরো এগিয়ে যাবে। কারণ এখন সবাই জানে, আমি খারাপ করলেও ব্যাকআপ খেলোয়াড় আছে। অন্য কেউ আমার জায়গায় চান্স পাবে। আর সে ভালো করে ফেললে আমার জায়গা নড়বড়ে হয়ে যাবে। এই চ্যালেঞ্জটা আগেও ছিল। তবে এখন সবচেয়ে বেশি। আমার কাছে মনে হয় এটা খুব ভালো জিনিস। বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যও, আমার জন্যও। পেস বোলারদের জন্য তো বটেই। প্রশ্ন : ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর আপনি রীতিমতো হিরো। এর পরই মুস্তাফিজের উত্থানে আপনারা সবাই তাঁর ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছেন। এতে পেশাদারি ঈর্ষা হয় না? রুবেল : সত্যি বললে হয় না। এতটা না হলেও একটা সময় আমাকে নিয়েও মানুষের উন্মাদনা ছিল। এখন সময়টা মুস্তাফিজের। ওর প্রতিভাও ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ বলেই ওকে নিয়ে এত কিছু হচ্ছে। কিন্তু আমার এখন এসব ভাবতে গেলে তো হবে না। তুলনায় গিয়ে সুফল পাওয়ার কোনো সুযোগই দেখি না। বরং নিজের কাজ নিয়ে ভাবলেই ভালো। প্রশ্ন : এবার আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই মুস্তাফিজের বিশেষত্ব? রুবেল : একজন পেস বোলারের আর যা-ই থাকুক, সবার আগে আত্মবিশ্বাস থাকা চাই। এই জিনিসটি থাকলে যেকোনো ব্যাটসম্যানকেই কাবু করা সহজ হয়ে যায়। যেটি মুস্তাফিজের আছেও। সেই সঙ্গে দুর্বোধ্য কাটার ও মারাত্মক ইয়র্কার যোগ হওয়ায় ও এত কার্যকরী। প্রশ্ন : বাংলাদেশের অনেক বোলারই নাকি এখন কাটার রপ্ত করার চেষ্টা করছেন। তা আপনি করছেন না? রুবেল : (হাসি...) না, না, আমার ওটা হবে না। কারণ আমার অ্যাকশন ভিন্ন। মুস্তাফিজ আর আমার অ্যাকশন এক নয়। আমার অ্যাকশনে বল করা একটু কঠিন। আমাকে অনেক কষ্ট করে বোলিং করতে হয়। কষ্ট আসলে সবাই করে। কিন্তু অ্যাকশনের কারণে কারো শরীরের ওপর চাপ একটু কম পড়ে, কারো বেশি। যেমন ধরুন ফরহাদ রেজার কথাই। মসৃণ অ্যাকশন ওনার। কিন্তু আমার অ্যাকশনে অনেক চাপ দিতে হয়। সারা শরীরে অনেক চাপ পড়ে। মুস্তাফিজের অ্যাকশনও মসৃণ। ওর আহামরি তেমন একটা কষ্ট হয় না। প্রশ্ন : মুস্তাফিজের কারণে কি বাংলাদেশের বোলারদের মধ্যে বোলিংয়ের নিত্যনতুন কারিকুরি বের করার প্রবণতা বেড়ে যায়নি? রুবেল : এটা জানি যে বিভিন্ন ধরনের স্লোয়ার বের করার চেষ্টাও কেউ কেউ করছে। কিন্তু এটা তো বললেই হয়ে যাবে না। আপনি যা চেষ্টা করছেন, তাতে সফল হবেন কি না, তাও তো দেখতে হবে। আমার মনে হয় কিছু কিছু জিনিস একদমই ঈশ্বর প্রদত্ত। যেমন মুস্তাফিজের কাটার। প্রশ্ন : আপনার নতুন কোনো ডেলিভারি? রুবেল : ইয়র্কার আর গুড লেন্থে জোরে হিট করা আমার মূল অস্ত্র। আর আমার আসল জিনিসই হলো আমি জোরে বোলার, জোরে বল করতে পছন্দ করি। তাসকিনেরও তাই। আমরা তো থ্রেট বোলার। থ্রেট দিয়ে বল করি। এটাই। এর পরও নতুন কিছু করার চেষ্টা থেমে নেই। একটি স্লোয়ার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বাটারফ্লাই নাম। কিন্তু এটা করা আমার অ্যাকশনে একটু কঠিনই। প্রশ্ন : বাংলাদেশের অনেক স্মরণীয় জয়েই তুলির শেষ আঁচড়টা আপনার বোলিংয়ে। তা কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন আপনি? রুবেল : অবশ্যই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করা জয়টি। ওই ধরনের পরিস্থিতিতে আগেও বোলিং করেছি। কঠিন হলেও আমি জানতাম যে পারব। মাশরাফি ভাই এসে বলেছিলেন, ‘সুযোগটা কাজে লাগা।’ আমিও ভেবেছি, এটা সেই সুযোগ যেটা কাজে লাগালে হিরো হওয়া যাবে। এই ধরনের সুযোগ জীবনে সব সময় আসবে না। প্রথম উইকেটটি পাওয়ার পর বিশ্বাস দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। মাথায় ঢুকে গিয়েছিল যে, ‘এই ওভারেই আমি শেষ করে দেব।’ প্রশ্ন : ২০০৯-এর জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঢাকায় ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে একই রকম পরিস্থিতিতে আপনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তা এখনো পোড়ায়? রুবেল : তখন যদি এখনকার মতো অভিজ্ঞ হতাম, তাহলে হয়তো মুরালিধরন ব্যাট হাতে শ্রীলঙ্কাকে জেতাতে পারতেন না। ওটা ছিল আমার মাত্র দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ওই পরিস্থিতিতে এত মানুষের সামনে আমি নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম বলেই ওরকম হয়েছিল। প্রশ্ন : তারকাখ্যাতি তো কখনো কখনো মানুষকে ভুলের ফাঁদেও ফেলে। তা আপনি পড়েছিলেন কখনো? রুবেল : (হাসি...) ভুল তো মানুষের জীবনে হবেই। আমারও কিছু কিছু ভুল ছিল। এর মধ্যে আবার একটি ভুল করে ফেলেছি। ভুলটি হলো বিয়ে করে ফেলেছি, কিন্তু সেই খবর মানুষকে জানাতে একটু দেরি হয়ে গেছে (হাসি...)। প্রশ্ন : ২০১৫ বিশ্বকাপের আগের সময়টাই কি জীবনের কঠিনতম ছিল? রুবেল : হ্যাঁ, তা তো বটেই। তবে মানুষ কোনো পরিস্থিতিতে পড়লে সেটা থেকে শিক্ষা নেয়। আমিও একটা সমস্যায় পড়ে অনেক কিছু শিখেছি। বুঝতে পেরেছি যে এই ধরনের সমস্যায় আর পড়া যাবে না। (হাসি...) এটা ঝামেলার! প্রশ্ন : ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে যেখানে দেখার ইচ্ছে? রুবেল : এমন কিছু করতে চাই যাতে মানুষ মনে রাখে যে যত দিন খেলেছে রুবেল জান দিয়ে খেলেছে। মানুষ যাতে বলে, ও যত দিন খেলেছে বাঘের মতোই ক্রিকেট খেলেছে। চাই ওয়ানডেতে আমার সবচেয়ে বেশি উইকেট থাকবে। হয়তো টেস্টে আমার অত উইকেট নেই, পারফরম্যান্সও অত ভালো না। অ্যাভারেজ একটু বেশি, উইকেটও কম। তবে ওয়ানডেতে ভালো। ওয়ানডের প্রতি আমার ঝোঁকটা একটু বেশিও। প্রশ্ন : টেস্টে ঝোঁক নেই কেন? রুবেল : টেস্ট খেলা এমনিতেও অনেক কষ্টের। তার ওপর আমার অ্যাকশনে বোলিং করা আরো কষ্টের। এ জন্য আমাকে আরো ফিট হতে হবে। এখন মাশাল্লাহ অনেক ফিটও হয়েছি। তার পরও আরো ফিট হতে হবে। টেস্টের জন্য সেই প্রস্তুতি আমি নিচ্ছিও।