কাশ্মীরের প্রতিটি মুহূর্ত এখনো উচ্ছল করে তোলে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। ভূস্বর্গের অপরূপ সৌন্দর্য, সেখানকার মানুষের অকাতর ভালোবাসার ‘হ্যাংওভার’ এখনো কাটেনি তাঁর। তবে এক সপ্তাহের কাশ্মীর ভ্রমণের একটি মুহূর্ত এখনো কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে মাশরাফির মনে। পেহেলবাগে স্কিইং করে ফেরার পথে ফেসবুকে এক বন্ধুর পোস্ট ‘মাশরাফি ইন কলাবাগান’—তথ্যটা দেখে ‘একটু অবাক হয়েছিলাম’, কাল মধ্যাহ্নে একাডেমির ছোট্ট ড্রেসিংরুমে মাশরাফির সেই বিস্ময়ে বেদনার গোপন আঁকিবুকি খুঁজতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। তবে তিনি পেশাদার, তাই পণ করেছেন কলাবাগানেও ফুল ফোটানোর সব চেষ্টাই করবেন। ক্যারিয়ারজুড়েই তো উপেক্ষার জবাবে ফুলই ফুটিয়েছেন মাশরাফি।
বিপিএলের প্রথম আসরে ‘আনসোল্ড’ থেকে যাওয়ার মতো কষ্ট তো আর এবার পেতে হয়নি মাশরাফিকে। সেবার দ্বিতীয় সুযোগে তাঁকে নিয়েছিল ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরস, বিনিময়ে পেয়েছিল শিরোপা। বিপিএলের সবশেষ আসরে লটারিতে মাশরাফিকে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে সাকিব আল হাসানকে না পাওয়ার বেদনাই বেশি ঝরিয়েছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের চেয়ারম্যান। এখন সেই তিনিই সুযোগ থাকলে পরবর্তী আসরে মাশরাফিকে নিজের দলে রেখে দিতে বদ্ধপরিকর। একবার চোটের কারণে পেস বোলিং করা বারণ, তাই স্পিন বোলিং দিয়েই শিরোপা জিতিয়েছিলেন আবাহনীকে। গতবার মোহামেডানের সুপার লিগ নিশ্চিত হয়েছিল টানা চার ম্যাচ জয়ে, যে জয়গুলো এসেছিল মাশরাফি দলে যোগ দেওয়ার পরে।
এবারও মোহামেডানেই খেলার কথা ছিল মাশরাফির। যদিও ‘প্লেয়ার্স বাই চয়েস’ গ্যাঁড়াকলে সে নিশ্চয়তা ছিল না। তবে গতবারের অধিনায়ককে চাইলে নিতেই পারত মোহামেডান। কিন্তু নেয়নি। নেয়নি প্রিমিয়ার লিগের ১২ ক্লাবের আরো ৯টিও। ভাগ্য ভালো যে পরিবার-পরিজন নিয়ে কাশ্মীরে ছুটি কাটানোয় ব্যস্ত থাকায় এক-দুই করে ১০টি ক্লাবের উপেক্ষা সরাসরি টিভিতে দেখা হয়নি বাংলাদেশের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়কের। এমনকি মোহামেডানও ‘মুখ ঘুরিয়ে’ নেওয়ার খবরটা ‘অবাক’ মাশরাফি জেনেছেন পরে। এ নিয়ে কি একটু মন খারাপ হয় না? প্রশ্নটা তুলতেই দ্রুত গার্ড নিয়ে নেন তিনি, ‘দেখুন, এটা পুরোপুরি ক্লাবের ইচ্ছা। যে যাকে খুশি ডাকবেন। এ নিয়ে মন খারাপ করে বসে থেকে তো কোনো লাভ নেই। আমি এখন একটা দলে আছি। চেষ্টা করব সেটা নিয়ে যতটা সম্ভব ভালো করা।’
সেই চেষ্টার অনুপ্রেরণাও রোমাঞ্চ। ‘সত্যি বলতে কি তাত্ক্ষণিক একটু অবাক হলেও নতুন ক্লাবে খেলা নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড। আবাহনী, মোহামেডান, বিমানের মতো বড় ক্লাবেই বেশি খেলেছি। একবার সিসিএস, আরেকবার বোর্ডের অনুমতি নিয়ে ইন্দিরা রোডে একটি ম্যাচ খেলেছিলাম। সে অর্থে এবারই প্রথম পুরো মৌসুম এমন একটা ক্লাবে খেলব, যেটা খুব নামি নয়। তবু আমি এক্সাইটেড, কারণ এমন দল নিয়ে ভালো কিছু করতে পারলে বেশি ভালো লাগবে,’ বলছিলেন কলাবাগানের অধিনায়ক মাশরাফি। দলে বড় নাম নেই, তবে সবার মনে বড় চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজটা অনুশীলনে নেমেই শুরু করে দিয়েছেন তিনি, ‘প্রচণ্ড গরম এখন। তা ছাড়া সবাই বিসিএল নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এই অল্প কদিনে তো স্কিলে উন্নতির খুব একটা সুযোগ নেই। তাই ছেলেদের বলেছি গরমে বেশি খাটাখাটনি না করে মনটাকে তৈরি করতে। বলেছি ক্লাব ক্রিকেটের কথা চিন্তা না করে সবাই যেন জাতীয় দলের মতো করে খেলার চেষ্টা করে। বেশির ভাগই তরুণ। তাই ওরা যেন ভাবে তিন-চার বছরের মধ্যে জাতীয় দলে জায়গা করতে হবে, লম্বা সময়ের জন্য জায়গা পেতে হবে। ক্লাবের গণ্ডিতে থেমে থাকলে হবে না।’
মাশরাফির ‘মূল্য’টা এ কারণেই বেশি। কোনো দলেই তিনি একজন খেলোয়াড়ই নন, অনুপ্রেরণাদায়ী পথপ্রদর্শকও। আর সামান্য উপেক্ষা বের করে আনে তাঁর সেরাটাও। প্রসঙ্গটা তুলতে মাশরাফি নিজেও মেনে নিয়েছেন, ‘এই ব্যাপারগুলো সব সময়ই আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। যেটাকে উপেক্ষা বলছেন, আমি সেভাবে দেখি না। আমি শুধু ভাবি মাঠে খেলেই জবাব দিতে হবে। ১৬ বছর ক্রিকেট খেলার পর আপনি টাকার চেয়ে বেশি চাইবেন সম্মান।’ সেই সম্মানটা বর্তমান ক্লাব থেকে বিস্তর পাচ্ছেনও মাশরাফি, ‘যখন যে ক্লাবেই খেলেছি, সব সময় সম্মান পেয়েছি। কলাবাগানের কর্মকর্তারাও ব্যতিক্রম নন। সব মিলিয়ে নতুন ক্লাবে আমি খুশি।’
পুরনো বন্ধু আবদুর রাজ্জাক আছেন, আছেন মেহরাব হোসেন জুনিয়রসহ আরো অনেক উঠতি ক্রিকেটার। যাঁদের নিয়ে দলটা সেরা কিংবা শিরোপাপ্রত্যাশী দাবি করতে আপত্তি আছে মাশরাফিরও। তবে কলাবাগানে ফুল ফোটানোর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা কিন্তু করে ফেলেছেন তিনি, ‘চ্যাম্পিয়ন হবই, বলছি না। অন্য দলের দুজন খেললেই যেখানে ম্যাচ জিতবে, সেখানে আমাদের হয়তো চারজনকে একসঙ্গে পারফর্ম করতে হবে। সেটা খুবই সম্ভব।’
কত আপাত অসম্ভবকেই তো সম্ভব করেছেন মাশরাফি বিন মর্তুজা।