ফুলগুলো
ওভার নম্বর ১৭
বাংলাদেশের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল বাছাইপর্ব পেরোনো। ধর্মশালায় প্রথম ম্যাচেই সেটি পড়ে গিয়েছিল সংশয়ে। হাতে ৬ উইকেট নিয়ে শেষ ৪ ওভারে ৪২ করলেই জিতে যায় হল্যান্ড। টি-টোয়েন্টিতে যা এমন কোনো ব্যাপার নয়। ওই সন্ধিক্ষণে ১৭তম ওভারটি করতে এলেন অধিনায়ক নিজেই। কী ওভারটাই না করলেন! ৬টি বলই ছিল দুর্দান্ত। ৩ রান দিয়ে ১ উইকেট, ক্যাচ না পড়লে যা হয়ে যেত ২ রান দিয়ে ২ উইকেট। মাশরাফির ওভারটিই বদলে দিল ম্যাচের রং। খুলে দিল বাংলাদেশের সুপার টেনে ওঠার দরজাও।
অপূর্ণতা ঘোচানো সেঞ্চুরি
এই সেঞ্চুরি শুধুই আরেকটি সেঞ্চুরি নয়। এটা বাংলাদেশের বড় একটা অপূর্ণতা ঘোচানোর সেঞ্চুরি। টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশেরই টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি ছিল না। ৫৮তম ম্যাচে এসে সেই আক্ষেপ ঘুচল তামিমের ব্যাটে। টুর্নামেন্টজুড়েই ছিলেন দুর্দান্ত। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪ রানে রানআউট হওয়ার আগে তাঁর ৫টি ইনিংস ৩৫, ২৪, অপরাজিত ১০৩, ৪৭ ও অপরাজিত ৮৩। গড় ছিল প্রায় এক শ ছুঁই-ছুঁই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তামিমকে না পাওয়াটা তাই আরও বেশি বুকে বেজেছে। শেষটা ভালো হয়নি। তার পরও যখন ফিরে গেছেন, টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রান তাঁর।
‘কিং অব কাটারস’
চোট নিয়ে প্রথম চার ম্যাচে বাইরে বসে থেকে খেলেছেন শেষ তিনটি ম্যাচ। তাতেই বিশ্বমঞ্চে হইচই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভালো, ভারতের বিপক্ষে আরও ভালো, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত। ইডেনে ২২ রানে ৫ উইকেটের পারফরম্যান্সের পর উইলিয়ামসন-টেলররা পর্যন্ত তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। টাইমস অব ইন্ডিয়া তো তাঁর নামই দিয়ে দিয়েছে ‘কিং অব কাটারস’! ইংলিশ কাউন্টি সাসেক্সে দ্বিতীয় বিদেশি হিসেবে টেলরের টিমমেট হতে যাচ্ছেন মুস্তাফিজ। টেলর সাসেক্স কর্তৃপক্ষকে এসএমএস করেছেন, রত্ন চিনতে তোমরা ভুল করোনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে মুস্তাফিজকে না পাওয়ার আক্ষেপটা কি তাতে আরও বাড়ল!
পাকিস্তানের বিপক্ষে সৌম্যর অবিশ্বাস্য ক্যাচক্যাচের জাদুকর
ব্যাট হাতে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। তার পরও সৌম্য ঠিকই ছাপ রেখে গেছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ইডেনে পাকিস্তানের বিপক্ষে সীমানায় দাঁড়িয়ে যে ক্যাচটি ধরেছেন, সেটিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো কোনো ক্যাচ এখনো দেখেনি এই বিশ্বকাপ। উপস্থিত বুদ্ধি, শারীরিক সক্ষমতা ও নমনীয়তার সঙ্গে ওভাবে ভাবতে পারার দুঃসাহস মিলিয়ে চিরকালীন এক কীর্তি হয়ে থাকবে ওই ক্যাচ। সেটির প্রতিদ্বন্দ্বীও কি সৌম্য নিজেই? ভারতের বিপক্ষে চিন্নাস্বামীতে স্কয়ার লেগে দৌড়ে গিয়ে সামনে ডাইভ দিয়ে নেওয়া ক্যাচটিও ছিল অসাধারণ। তবে ইডেনেরটাই বোধ হয় এগিয়ে।
ভুলগুলো
তিন বলের দুঃস্বপ্ন
ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে যেমন ‘মারাকানা ট্র্যাজেডি’, বাংলাদেশের ক্রিকেটেও এটি তা-ই? তুলনাটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি। তবে চিন্নাস্বামীর ওই দুঃস্বপ্নের রাত চিরকাল না হলেও আরও অনেক দিন যে বাংলাদেশকে তাড়িয়ে বেড়াবে, এটা বলায় কোনো বাড়াবাড়ি নেই। মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহকে তো আরও বেশি। এটা নিয়ে কথা বলতেও যাঁদের কষ্ট হয়। বলছেনও না। ৩ বলে ২ রান করতে না পারার ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা একটাই, অনভিজ্ঞতা। আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে ভারতীয় দর্শকে ঠাসা স্টেডিয়ামে ভারতকে আমরা বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দিচ্ছি—এটা ভেবে মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে গিয়েছিল ওই দুজনের। এটাকেই তো ‘চোক’ বলে, তাই না?
শেষের ব্যর্থতা
শেষটা ভালো করার তৃপ্তি ছাড়া আর কিছু পাওয়ার ছিল না এই ম্যাচে। অথচ শেষটাই হয়ে গেল সবচেয়ে খারাপ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যেভাবে ধসে পড়ল বাংলাদেশের ব্যাটিং, এমন কিছু খুঁজে পেতে ২০১১ বিশ্বকাপে ফিরে যেতে হচ্ছে! ভারতের বিপক্ষে অমন হার যেকোনো দলকেই বিপর্যস্ত করে দিত। কিন্তু পেশাদার দল সেটি পেছনে ফেলে আবার উঠেও দাঁড়াত। এখানেই বড় একটা ঘাটতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ৭০ রানের লজ্জা।
ব্যাটিং ব্যর্থতায় কিউইদের কাছে লজ্জার পরাজয়নাসিরের একমাত্র ম্যাচ, হল্যান্ডের বিপক্ষেসেরা পনেরো?
নাসিরকে বসিয়ে রেখে মাত্র উড়ে আসা শুভাগত হোমকে খেলানোর দুটি অর্থ হতে পারে। হয় নাসির হঠাৎই খেলা ভুলে গেছেন, অথবা তাঁকে দলে নেওয়াটাই ভুল ছিল। দল থেকে নানা রকম কথা শোনা গেছে। নাসির সিরিয়াস নন, এক দিনও ঐচ্ছিক অনুশীলনে যাননি, মিডিয়াম পেস খেলতে গিয়েও স্কয়ার লেগের দিকে ‘পালিয়ে’ যাচ্ছেন। এসব যদি সত্যিও হয়, এই সমস্যা তো এখানে এসে ধরা পড়ার কথা নয়। স্বাভাবিকভাবেই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক সিনিয়র খেলোয়াড়ের কথাটাও ভেবে দেখার মতো, ‘নাসির যখন ভালো খেলেছে, তখনো এসব ছিল। কই, তখন তো এসব নিয়ে কথা হয়নি।’ নাসিরকে নিয়ে দুই মত আছে, তবে এই দলে অন্তত দু-তিনজন খেলোয়াড়ের এই পর্যায়ে খেলার উপযুক্ততা নিয়ে যা নেই। প্রস্তুতি ম্যাচে দুটি ইনিংস দেখে হাথুরুসিংহে মোহাম্মদ মিঠুনকে নিয়ে নিয়েছেন। যেখানে ইমরুল কায়েস হয়তো আরও ভালো পছন্দ হতেন। আবু হায়দার এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত নন। নুরুল হাসানও হয়তো তা-ই। বদলি হিসেবে উড়ে আসা সাকলাইন সজীবকে নিয়েও একই প্রশ্ন। উল্টো আবদুর রাজ্জাককে আরও ভালো করে মনে করিয়ে দিয়েছেন, যাঁকে একটু তাড়াতাড়িই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন নির্বাচকেরা।
এবং কাঁটা
কনুই-বিতর্ক
এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা কোনটি? মাঠে অবশ্যই বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ। মাঠের বাইরেও বাংলাদেশ! হল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই আম্পায়ারদের কাঠগড়ায় বাংলাদেশ দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই বোলার। আরাফাত সানির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আগে থেকেই সংশয় থাকলেও তাসকিনেরটা ছিল বিস্ময়। পরীক্ষায় যেহেতু কেউই ‘পাস’ করতে পারেননি, ধরে নেওয়া উচিত, দুজনেরই হয়তো কিছু না কিছু সমস্যা আছে। তবে তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময়টা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। এত দিন নির্বিঘ্নে খেলে আসার পর বিশ্বকাপের মতো আসরে কেন? ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব’ তো ডালপালা মেলবেই!