ভিডিওটি দেখলে বিশ্বাস হবে না। বক্সিং রিঙে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে লড়ছেন ১২ বছরের এক পুঁচকে। কোমর সমান উচ্চতা নিয়ে সে অবলীলায় ঘুষি মারছে আলীর পেটে। মার খেয়ে একপর্যায়ে লুটিয়ে পড়লেন আলী। ঢাকায় এসে হেরে গেলেন শতাব্দীর সেরা বক্সার মোহাম্মদ আলী! দৃশ্যটা দেখে কেউ কেউ হাসিতে ফেটে পড়ল, তারপর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম করতালিতে অভিবাদন জানাল মহান অভিনেতাকে! সেই বিশেষ দিনটা ছিল ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন বক্সিং রিঙে অভিনয় করেছিলেন ১২ বছরের গিয়াস উদ্দিনের সঙ্গে। আর সেই থেকে বিখ্যাত মোহাম্মদ আলীর জীবনের সঙ্গে জুড়ে আছে গিয়াস উদ্দিন ও বাংলাদেশ। তাই শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদের প্রয়াণে ৫০ বছর বয়সী গিয়াসের শ্রদ্ধার্ঘ্য, ‘রিঙে আলীর সঙ্গে খেলা আমার জীবনের দুর্দান্ত একটা মুহূর্ত। একইসঙ্গে তাঁর চলে যাওয়াটা বড় দুঃখের। তিনি না থাকলেও তাঁর কীর্তি অমর হয়ে থাকবে।’
মোহাম্মদ আলী ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন সপরিবারে। পাঁচ দিনের সফরে ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। এ উপলক্ষে অস্থায়ীভাবে নির্মিত বক্সিং রিঙে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ হয়েছিল। তাতে কিন্তু খেলার কথা ছিল বক্সার আব্দুল হালিমের। কেবল আগের বছরই ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জেতেন। সুবাদে দেশের সেরা বক্সারকে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুখোমুখি করিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ধন্য হবে হালিমের জীবন। কিন্তু বাদ সাধেন আলী, ‘উনার সঙ্গে আমার বক্সিং করার কথা ছিল। কিন্তু উনি বললেন আমি তো বড় কারোর সঙ্গে লড়ব না। ছোট কাউকে দেন। শুধু মজা করব। তখন তিনি বাসাবোর গিয়াসের সঙ্গে রিঙে লড়াই করেন। গিয়াসের একটি ঘুষিতে অভিনয় করে পড়ে গিয়েছিলেন। তার আগে সাংবাদিকেরা ছবি তুলতে চাইলে আমার মুখের কাছে ঘুষি নিয়ে ফটোগ্রাফারদের বলেন, এবার ছবি তোলেন।’ কিংবদন্তির মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে হালিমকে। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তিনি একটা যুগের সৃষ্টি করেছেন। আগে বক্সিংটা মারামারির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। ওই সময়ে বক্সিংয়ের লেফট ক্রস, রাইট ক্রস শিখেছি তাঁর কাছে। কেউ গার্ড করে রাখলে ঘুষি দেওয়া যায় না। কিন্তু হাত বন্ধ করে সেকেন্ডের মধ্যে উনি ঘুষি দিতেন।’
তিনি আসলে ঘুষোঘুষি করতে আসেননি, দেশটাকে দেখতে এসেছিলেন। ঢাকার গণসংবর্ধনা বাদেও পাঁচ দিনের সফরে তিনি ঘুরেছেন বিভিন্ন জায়গায়। সিলেটে চা বাগানে গিয়ে সবুজের সমারোহ উপভোগ করেছেন। বাগানিদের সঙ্গে চা তুলেছেন সপরিবারে। মুচকি হেসে বাগানিরা হাত মিলিয়েছেন তাঁর সঙ্গে। রাঙামাটি গিয়ে উপজাতি মেয়েদের সঙ্গে নেচেছেন। পুরো সফরে বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেশের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, ভাব বিনিময় করে মানুষের হৃদয় জিতেছেন। কিংবদন্তিও যেন ভীষণভাবে এ দেশের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। ‘তুমি যদি স্বর্গে যেতে চাও তাহলে বাংলাদেশে আসো’—এমন উদাত্ত আহ্বানে তিনি মাত্র সাত বছর আগে স্বাধীন হওয়া দেশটিকে তুলে ধরেছিলেন বহির্বিশ্বের কাছে। এই সফরে স্ত্রী ভেরোনিকা ও মেয়ে লায়লা আলীকে নিয়ে সময় কাটিয়েছিলেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। জায়গাটা তাঁর এত পছন্দ হয়েছিল সৈকতের পাশে একখণ্ড জায়গা দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল। তবে এ ঘোষণায় কোথায় যেন একটু খাদ ছিল। কারণ জায়গাটা ঠিকঠাক দেওয়ার ব্যাপারে আর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এমনকি জেলা ভূমি অফিসে গিয়েও আমেরিকান চ্যাম্পিয়ন বক্সার মোহাম্মদ আলীর নামে কোনো জায়গার খোঁজ মেলেনি।
তবে এই কিংবদন্তিকে ভালোবেসে নাগরিকত্ব দিয়েছিল তখনকার বাংলাদেশ সরকার। এটা সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, কিন্তু তিনি এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে বাংলাদেশকে নতুন ঘর ভাবতে শুরু করেছিলেন, ‘আমাকে আমেরিকা বের করে দিলেও চিন্তার কিছু নেই। আমার আরেকটা বাড়ি আছে, বাংলাদেশ, যা আমার কাছে স্বর্গ। আই লাভ ইউ।’
বাংলাদেশও প্রাণভরে ভালোবাসে আলী, আপনাকে!