তুখোড় ফর্মে মুশফিকুর রহিম। মোহামেডানের ব্যাটিং লাইনের প্রাণভোমরা তিনি। মাঠে নামলেই যেন হাফসেঞ্চুরি, জাদুকরী তিন অঙ্ক ছোঁয়া সেঞ্চুরিও করা সারা। তার পরও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ ১০ ব্যাটসম্যানের মধ্যে নেই মুশফিক!
আবাহনীর ব্যাটিংয়ের আলোর মশাল হাতে সামনে তামিম ইকবাল। মাঠে নামলেই যেন বড় স্কোরের নিশ্চয়তা। দল যতই খাবি খাক না কেন, এ ওপেনারের ব্যাট হাসছেই। কিন্তু সেরা দশে নেই তো তামিমও!
মুশফিক-তামিমদের যখন এ অবস্থা, বাংলাদেশ দলের অন্যদের অবস্থা তখন অনুমেয়। প্রিমিয়ার লিগের সাত রাউন্ড শেষে সেরা ১০ ব্যাটসম্যানের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারেননি জাতীয় দলের কেউ। কেউ না!
বোলিংয়ের অবস্থা এর চেয়ে খানিক ভালো। খানিকটাই! সীমিত ওভারের ক্রিকেটের সাম্প্রতিক জাতীয় দলগুলোর মধ্য থেকে একমাত্র প্রতিনিধি সেখানে পেসার আল-আমিন হোসেন। ও হ্যাঁ, লেগস্পিনার জুবায়ের হোসেনও রয়েছেন সেরা দশে। কিন্তু বাংলাদেশ দলের রঙিন জার্সিতে তাঁকে আবার কবে দেখা যাবে, এ নিয়ে ঘোরতর সংশয় এ দেশের ক্রিকেটের অন্দরমহলে।
এবারের প্রিমিয়ার লিগে জাতীয় দলের চেয়ে বাইরের ক্রিকেটাররা আলো ছড়াচ্ছেন বেশি। বিদেশি ক্রিকেটারদের রাজত্ব সেখানে, জাতীয় দলে ব্রাত্যদের জয়জয়কার। এমনকি তরুণদের ব্যাটে-বলেও রয়েছে আশার ঝলকানি। সাত রাউন্ড শেষের পরিসংখ্যান অন্তত সে সাক্ষ্যই দেয়।
জাতীয় দলের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রান শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবের অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহর। ২৯৬ রান তাঁর, তবে সাত ইনিংসের মধ্যে ৫০ পেরোনো স্কোর একটিই—সিসিএসের বিপক্ষে ১৩০ রান। সর্বশেষ ম্যাচে সেঞ্চুরি করা প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাবের নুরুল হাসানের রান ২৮২। সাত ম্যাচের ছয় ইনিংসে মুশফিকের রান ২৭৫; সাত ইনিংস খেলা তামিমের আরো চার রান কম। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলা মোহাম্মদ মিঠুনের রান ২৭২। ইমরুল কায়েসের ২৬২। পাঁচ ইনিংসে ৭৭ গড়ে ২৩১ রান করা প্রাইম দোলেশ্বরের নাসির হোসেনকে ব্যর্থ বলার উপায় নেই। প্রাইম ব্যাংকের সাব্বির হোসেনকে যেমন সফল বলা যাবে না কোনোভাবে। সেঞ্চুরি একটি করেছেন ঠিক, তবে সাত ইনিংসে ৩২.১৪ গড়ে ২২৫ রানের চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল তাঁর কাছে। লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের সৌম্য সরকারও প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ চরমভাবে। লিগে মাত্র ১৫৩ রান তাঁর, মোটে একটি ৫০ পেরোনো ইনিংস। বদলি হিসেবে গিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে আসা শুভাগত হোম প্রাইম ব্যাংকের জার্সিতে করেছেন ১৩৪ রান।
জাতীয় দলের তারকারা যখন জ্বলছেন এমন মিটিমিটি, তখন সবচেয়ে ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের হ্যামিল্টন মাসাকাদজার ব্যাট। দুই সেঞ্চুরি, এক ফিফটিতে ৫৯.৮৫ গড়ে ৪১৯ রান নিয়ে ব্যাটিং তালিকায় সবার ওপরে এ জিম্বাবুইয়ান। বাংলাদেশিদের মধ্যে সবার ওপরে প্রাইম দোলেশ্বরের ইমতিয়াজ হোসেন। ৩১ বছর পেরোনো এ টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান দুটি করে সেঞ্চুরি-হাফসেঞ্চুরিতে করেছেন ৪০৪ রান। জাতীয় দলের সম্ভাব্যদের তালিকায় কখনো বিবেচনায় না আসা ইমতিয়াজের গড়ও ঈর্ষণীয়—৬৭.৩৩। ৩৮৬ রানে ৩ নম্বরে মোহামেডানের শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যান উপুল থারাঙ্গা।
সেরা দশে নেই আর কোনো বিদেশি। সেখানে বরং বাংলাদেশের অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের জয়ধ্বনি। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলের হিসাবের বাইরে চলে যাওয়া গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের এনামুল হক (৩৮৪), আরো কিছুদিন আগে নির্বাচকদের গুডবুক থেকে নাম কাটা যাওয়া একই ক্লাবের শামসুর রহমান (৩৪৫) এবং অনেক দিন আগেই ব্রাত্য হয়ে পড়া ব্রাদার্সের শাহরিয়ার নাফীস (৩২১) জায়গা করে নিয়েছে সদর্পে। বীরদর্পের উপস্থিতি তারুণ্যের প্রতিনিধি হিসেবে ভিক্টোরিয়ার আল-আমিন (৩৭৪), ক্রিকেট কোচিং স্কুলের সাইফ হাসান (৩৫০), সালমান হোসেন (৩০১) এবং লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের আসিফ আহমেদের (২৯৬)।
জাতীয় দলের মূল দুই বোলার সাকিব আল হাসান ও মুস্তাফিজুর রহমান ব্যস্ত আইপিএল নিয়ে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তাই এখনো মাঠে নামা হয়নি। তাঁদের বাংলাদেশ দলের সতীর্থদের অবস্থা এখানে সুবিধার নয় খুব। ১৯ উইকেট নিয়ে ভিক্টোরিয়ার শ্রীলঙ্কান বোলার চতুরঙ্গ ডি সিলভা সাফল্যের শীর্ষে। সমান ১৩ উইকেট নিয়ে এরপর রয়েছেন আবাহনীর জুবায়ের হোসেন, মোহামেডানের নাঈম ইসলাম, এনামুল হক জুনিয়র, প্রাইম দোলেশ্বরের আল-আমিন হোসেন ও ভিক্টোরিয়ার কামরুল ইসলাম। এঁদের মধ্যে পেসার আল-আমিনই কেবল এখনকার জাতীয় দলের সীমিত ওভারের নিয়মিত বোলার। ১২ উইকেট নিয়ে শীর্ষ দশের বাকি চারটি স্থান মোহামেডানের হাবিবুর রহমান, গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের অলক কাপালি, সিসিএসের তরুণ বাঁহাতি স্পিনার সালেহ আহমেদ এবং কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার আবদুর রাজ্জাকের। বাংলাদেশের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং এ বছরই দেশের জার্সি গায়ে ওঠা লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের পেসার আবু হায়দারও ১২টি করে উইকেট পেয়েছেন ঠিক; কিন্তু গড়ে পিছিয়ে থাকায় সেরা দশে ঠাঁই হয়নি তাঁদের।
ঠিক যেমনিভাবে জায়গা হয়নি মাহমুদ উল্লাহ (১১ উইকেট), রুবেল হোসেন (৯), সাকলাইন সজীব (৯), তাসকিন আহমেদ (৯), শুভাগত হোম (৬), নাসির হোসেনের (৫)। বাঁহাতি স্পিনার আরাফাত সানি পেয়েছেন ২ উইকেট। অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ অ্যাকশন নিয়ে কাজ করার কারণে মাত্র দুটি ম্যাচে মাঠে নামেন তিনি। একই অভিযোগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফেরত আসা আবাহনীর পেসার তাসকিন অবশ্য খেলেছেন সাতটি ম্যাচই। গড়পড়তা বোলিংয়ে ৯ উইকেটের বেশি নিতে পারেননি। এর মধ্যে সেরা ২৯ রানে ২ উইকেট!
অন্যদের পাশে বাংলাদেশ জাতীয় দলের তারকারা সত্যিই অনুজ্জ্বল। অন্তত তাঁদের কাছে প্রত্যাশাটা ছিল এর চেয়ে ঢের বেশি!