গলফে লড়াই যতটা না প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তার চেয়ে বেশি নিজের সঙ্গে। শেষদিনে শিরোপার হাতছানি থাকলে তো কথাই নেই, তুমুল যুদ্ধ চালাতে হয় স্নায়ুচাপকে পাশ কাটাতে। তাতে সিদ্দিকুর রহমানের খুব খ্যাতি আছে তা নয়। বরং তীরে এসে তরী ডোবানোর ঘটনাই তাঁর বেশি। কাল আরো একবার আশার ভেলা ভাসতে ভাসতে ডুবে গেল ভারত মহাসাগরে, মরিশাসের এক উপভোগ্য বিকেলে। সারাটা দিন শিরোপা স্বপ্ন জাগিয়ে বাংলাদেশি এই গলফার হেরে গেলেন একেবারে শেষ শটে। পাঁচ ফুটি পাটটা তিনি করতে পারলেন না, কোরিয়ান জংহুন ওয়াং সুযোগটা নিলেন, সিদ্দিকের এরপর আর ফেরার সুযোগ ছিল না। এশিয়ান ট্যুরে তৃতীয় শিরোপা জয়ের এত কাছেও গিয়েও আবার ফিরলেন শূন্য হাতে। মরিশাস ওপেনের এ শিরোপার আকর্ষণ ছিল যে আরো কয়েক গুণ বেশি। কারণ ইউরোপিয়ান ট্যুরেরও স্বীকৃত এ আসর। তাতে প্রথম ইউরোপিয়ান ট্রফি জেতার সুযোগটাও তিনি হারালেন।
শেষ স্কোরলাইন, ওয়াং ৬-সিদ্দিকুর ৫। অথচ ১৬ নাম্বার হোলে খেলা শুরুর আগেও সিদ্দিক এই কোরিয়ানের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন ৮-৫-এ। ভুতুড়ে কাণ্ডটা ঘটল ৪ পারের ওই হোলেই। প্রথম টি শটটাই তিনি এত বাজে মারলেন যে সেটি ওই হোলের সীমানারই বাইরে গিয়ে পড়ল। ফলে ১ শট পেনাল্টি। দ্বিতীয়বারেও এর চেয়ে ভালো কিছু করতে পারলেন না, খেললেন বোগি, আর আগের এক শট ‘গচ্চা’, তাতে ১৬ নাম্বার হোলেই তাঁর হয়ে গেল ডাবল বোগি। ওয়াং ওই হোলে ঠাণ্ডা মাথায় খেললেন পারের সমান। স্কোর ব্যবধান নেমে গেল তাতে ৬-৫-এ। সিদ্দিক এ ধাক্কায় পরের হোলেও খেললেন বোগি। গত বছর প্যানাসনিক ওপেন এবং এর আগে হিরো ইন্ডিয়ান ওপেনের চিত্রনাট্যই যেন, দারুণ সম্ভাবনা জাগিয়ে শেষ মুহূর্তে সব গড়বড় করে ফেলা। তার পরও শেষ হোলে সুযোগটা ছিল, শেষ শটেও। সচরাচর চোখ বুজে যে পাট করে ফেলেন, মরিশাসের দুর্ভাগা দিনে তা আর হলো না। ২০ বছর বয়সী ওয়াংয়ের কাছে হেরে গেলেন। বয়সে এ কোরিয়ানকে অবশ্য বিচার করা যাবে না। ইউরোপিয়ান ট্যুরের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ট্যুরে এটি তাঁর টানা দ্বিতীয় শিরোপা। এ মাসেই মরক্কোতে জিতেছেন ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ইউরোর হাসান টু গলফ ট্রফি। কাল ১ মিলিয়ন ইউরোর মরিশাস ওপেন জিতে তিনি পকেটে পুরলেন এক লাখ ৬৭ হাজার ইউরো। রানারআপ হওয়া সিদ্দিকের আয়ও কম নয়, তিনি পেয়েছেন এক লাখ ১১ হাজার ইউরো। এ বছর এর আগের ৮ টুর্নামেন্টে জেতা তাঁর মোট প্রাইজমানিও এর ধারেকাছে নয়। সেই ৮ টুর্নামেন্টের ৩টিতে কাট হারিয়ে তিনি মোট জিতেছিলেন ২৫ হাজার ইউরো।
এবারের মরিশাস ওপেনে সিদ্দিকের শিরোপা লড়াইয়ে ঢুকে পড়াটা তাই অবাক করাই ছিল। ৪ আন্ডার পারে টুর্নামেন্ট শুরুই করেছেন তিনি দুইয়ে থেকে। পরের রাউন্ডে পেছালেও এক ধাপ, সেরা রাউন্ডটা খেলেন তিনি তৃতীয় দিনে, ৩ আন্ডার খেলে মোট ৭ আন্ডার পার নিয়ে উঠে আসেন শীর্ষে। কাল শেষ রাউন্ডের ১৬তম হোল পর্যন্ত সেই অবস্থানটা তিনি ধরেও রেখেছিলেন। স্নুায়ুচাপের কাছে হেরে বসেন শেষ তিন হোলেই। জংহুন গায়ে গায়ে লেগেই ছিলেন, সিদ্দিক সুুযোগ হারাতেই সেটি তুলে নিতে তিনি ভুল করেননি। ‘আমি জানি না কিভাবে কী হলো, ১৬ হোল পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ওই হোলে যা হলো তা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলতে পারি! তবে সব মিলিয়ে আমি অখুশি নই, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ভাবতেও পারিনি রানারআপ হব। ইউরোপিয়ান ট্যুরে প্রথমবারের মতো লিডার গ্রুপে খেললাম টানা দুই রাউন্ড—এ অভিজ্ঞতাও আমার জন্য কম নয়।’ সিদ্দিকের খেলা শেষের প্রতিক্রিয়ায় আনন্দ-বিষাদ এভাবেই মাখানো। বরাবর ইতিবাচক থাকা তাঁর স্বভাব। তাতে প্রাপ্তি যেমন কম নয়, তেমনি মুহূর্তের স্খলনে হারিয়েছেনও অনেক। শেষ পর্যন্ত তিনি সামনেই তাকিয়েছেন। মরিশাস ওপেনের এ পারফরম্যান্স ধূসর হয়ে যাওয়া তাঁর অলিম্পিক স্বপ্নও যেমন ফিরে এসেছে বললেন। র্যাংকিংয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরই আসলে বোঝা যাবে এগিয়েছেন কতটা। তবে কাল এশিয়ান ট্যুর র্যাংকিংয়েই ৬১তম থেকে ১০ম অবস্থানে দিয়েছেন দীর্ঘ লাফ। অলিম্পিক র্যাংকিংয়েও তার প্রভাব পড়ার কথা।