খেলার মাঠে পরিচয়। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে গভীর হয়েছে। কবে কখন একজন হয়ে গেছেন আরেকজনের পরিপূরক, বুঝতেই পারেননি। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন জুটি রয়েছেন বেশ কজন। সেই দম্পতিদের ঘরের খবর উঠে এসেছে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনে। আজ থাকছে ব্যাডমিন্টনের সাবেক ও বর্তমান জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এনায়েত উল্লাহ খান ও এলিনা সুলতানার গল্প.স্নেহময়ী মা। চিরচেনা স্ত্রী। মেধাবী ছাত্রী। ব্যাডমিন্টনের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। এক এলিনা সুলতানারা নানা পরিচয়! তাঁর একই অঙ্গে কত যে রূপ!
চুলায় ভাত চড়িয়ে এলিনা বসেন পড়ার টেবিলে। পাশে বসা তিন বছরের মেয়ে আরশির হাতে তুলে দেন রং পেনসিল। মেয়ে আপন মনে আঁকিবুকি কেটে চলে সাদা কাগজে। এলিনা মন দেন পড়ালেখায়। একটু বাদেই আবার উঠতে হয়। গন্তব্য—পল্টনের উডেনফ্লোর জিমনেসিয়াম। ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছেন স্বামী এনায়েত উল্লাহ খান। এলিনাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নয়, এক সঙ্গে অনুশীলন করবেন বলেই দুজন ছুটছেন জিমনেশিয়ামে। এনায়েতও যে একজন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়।
এনায়েত-এলিনা শাটলার দম্পতি। এনায়েত জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ২০১১ সালে। বর্তমান জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এলিনা।
দুজনের পরিচয়পর্বের গল্পটা দারুণ মজার। ২০০২ সালে খুলনার মেয়ে এলিনা ব্যাডমিন্টন খেলতে চলে এলেন ঢাকায়। মায়ের হাত ধরে উডেনফ্লোর জিমনেসিয়ামে ঢুকে খুঁজতে লাগলেন এনায়েতকে। খুলনার কোচ পলাশ (বর্তমানে যুক্তরাজ্য প্রবাসী) এনায়েতের সঙ্গেই এলিনাকে দেখা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এনায়েতকে চেনেন না এলিনা! এনায়েতকে গিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে এনায়েত কে, বলতে পারেন?’ হেসে সেদিন উত্তর দিয়েছিলেন এনায়েত, ‘যাকে খুঁজছেন আমি সেই।’ পলাশের অনুরোধে এনায়েত এলিনার কোচের দায়িত্ব নিলেন সেদিন। এলিনার খেলায় কোথায় ভুলত্রুটি, কোথায় সমস্যা শুধরে দিতে লাগলেন
একসঙ্গে খেলতে, অনুশীলন করতে করতে দুজনের মধ্যে এক সময় তৈরি হয় বোঝাপড়ার সম্পর্ক। সেই বোঝাপড়াই ততদিনে রূপ নিয়েছে ভালো লাগায়। দুজনে এক সঙ্গে মিশ্র দ্বৈতে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলতেও শুরু করেছেন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলতে ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াতে গেছেন দুজনে। ভালোলাগার এই ব্যাপারটা দুজনের মধ্যেই ছিল, প্রথম সেটা প্রকাশ করেন এনায়েতই। এলিনাও আর না করেননি। তবে তিনি পরিবারের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন সব ভার। ভালো লাগাটা নিভৃতে হলেও ২০১১ সালের ৮ জুলাই দুই পরিবারের সম্মতিতেই একে অপরকে তাঁরা বেছে নেন জীবনসঙ্গী হিসেবে।
কোর্টে অনেকবারই এনায়েত-এলিনা জুটি মিশ্র দ্বৈতে খেলেছেন। কোর্টের বাইরে দুজনের বোঝাপড়াটা কেমন? এনায়েতের উত্তর, ‘কোর্টের ভেতরে ও একটু টেম্পারড থাকে। আমি ওকে বুঝিয়ে বললে পরে শান্ত হয়। আর সংসারে দুজনের বোঝাপড়াটা দারুণ। মাঝে মধ্যে দ্বিমত হলেও দুজনেই দুজনার ভুল স্বীকার করি। আজ পর্যন্ত কোনো দিন ও ঝগড়া করে বাবার বাড়ি চলে যায়নি।’
এলিনা ইডেন কলেজের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী। এপ্রিলে ফাইনাল পরীক্ষা। এর ওপর আজ থেকে শুরু হয়েছে জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ। সেই সঙ্গে ছোট্টো আরশির খাওয়া-দাওয়া যত্ন-আত্তি তো আছেই।
সংসার, সন্তান, পড়াশোনা, খেলা—সব সামলানো যেন বিশাল এক চ্যালেঞ্জ এলিনার জন্য, ‘পরীক্ষার দুই-তিন মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়াটা শুরু হয়। পড়া শেষ হলে এনায়েতের সঙ্গে অনুশীলনে চলে যাই। কষ্ট তো হয়ই।
তবে খেলা থাকলে খুলনা থেকে আম্মুকে নিয়ে আসি। আম্মু মেয়েকে সামলান।’ পরিবারের এমন সমর্থন পান বলেই এতদূর আসা এলিনার, ‘মা-বাবা তো সাহায্য করেই। স্বামীও অনেক সহযোগিতা করে। সে সহযোগিতা না করলে এত দূর আসতেই পারতাম না।’ এত কষ্ট। তবুও খেলার নেশা কিছুতেই ছাড়তে পারেন না এলিনা, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের সবার আগে সংসার সামলাতে হয়। জানি এই খেলায় কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কিন্তু এটা যে রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। চাইলেও খেলা ছাড়তে পারব না।’
এনায়েত সম্পর্কে এলিনার মূল্যায়ন, ‘ও স্বামী হিসেবে দারুণ। যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন আমাদের প্রতি অনেক যত্নবান।’ কতটা যত্নবান এর একটা উদাহরণও দিলেন এলিনা, ‘মেয়ে হওয়ার দেড় মাস পর থেকে অনুশীলন শুরু করেছি। সন্তান হয়েছে অস্ত্রোপচার করে। এমন অবস্থায় অনেকের দেড়-দুই বছর পর্যন্ত নানা ধরনের সমস্যা হয়। কিন্তু আমি দেড় মাসের মধ্যেই অনুশীলন শুরু করতে পেরেছি শুধু ওর সহযোগিতার জন্য।’
ফর্মের তুঙ্গেই আছেন এলিনা। কিন্তু এনায়েত এই জায়গায় যেন কিছুটা দুর্ভাগা। ট্রফির খরাটা তাঁর যেন কাটতেই চাচ্ছে না। এলিনা তাঁকে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। এই শাটলার দম্পতির স্বপ্ন, একসঙ্গে দুটো ট্রফি নিয়ে বাড়ি ফেরার।
এনায়েত-এলিনার এই স্বপ্নটা সত্যি হোক!