কী ভাই, মনে পড়ে?’
ভারতের বিপক্ষে ৩ বলে ২ রানের সমীকরণ মেলাতে না পারার তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে থাকা মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদ উল্লাহর কাছে অজ্ঞাতনামা এক ক্রিকেটভক্তের রাখা প্রশ্ন এটি। যে প্রশ্ন রাখার আগে-পরে ওই ভক্ত সোনালি স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মতো এ দুই ব্যাটসম্যানের একেকটি কীর্তিকেও গেঁথেছেন এক সুতোয়।
তাতে দাঁড়িয়ে যাওয়া ভিডিওটি মুশফিকের দুঃখভারাক্রান্ত হূদয়ের ভার অনেকখানি কমিয়েছে নিঃসন্দেহে। না হলে সেটি হাতে আসতে না আসতেই কেন নিজের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে শেয়ার করবেন! সেই সঙ্গে লিখে দেওয়া এ কথাটিও নির্ভার মুশফিককে অনেকটাই তুলে ধরতে পেরেছে, ‘এই ভিডিওর নির্মাতাকে ধন্যবাদ। দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী এক ভিডিও এটি।’
যে ভিডিওর নির্মাতা এর আগে তাঁদের দুজনের ব্যাটেই দেখা দেওয়া সাফল্যের বিশাল এক খতিয়ানই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ‘রিয়াদ ভাই, মুশফিক ভাই। পর সমাচার এই যে, টেনশন নিয়েন না! কিসের টেনশন? ২ রান নিতে পারেন নাই, তাই? ভাই, আপনারা দুজন মিলে এরকম কয় শো রান করে দিয়েছেন, হিসাব আছে? শুনবেন? আচ্ছা কয়েকটি বলি’—বলে সেই যে শুরু করেছেন লম্বা ফিরিস্তি, তাতে ভক্ত হূদয়ে তাঁদের দুজনের ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্যের উজ্জ্বল উপস্থিতির বার্তাই পেয়েছেন মুশফিকরা।
ভারতের বিপক্ষে জয়ের তীরে এক পা দিয়ে রেখেও জিততে না পারার দায় নিয়ে এক ফেসবুক বার্তার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই জাতির কাছে দুঃখ প্রকাশ
করেছেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক। কিন্তু সেটিরও প্রয়োজন ছিল না বলেই মনে করেছেন ওই ভক্ত, ‘মুশফিক ভাই, মাফ চাওয়ার কী আছে? বেশি না বলি। একটা শুধু মনে করাই।’ মুশফিকের সেই ‘একটি’ ইনিংস মাত্র ২৫ বলে অপরাজিত ৪৬ রানের। তিনটি করে ছক্কা ও বাউন্ডারিতে সাজানো যে ইনিংসটি শচীন টেন্ডুলকারের শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির আনন্দকে হারের হতাশায় বিলীন করেছিল ২০১২ সালের এশিয়া কাপে। ভারতের ২৮৯ রান তাড়া করে ৪ বল বাকি থাকতেই ৫ উইকেটে জেতা বাংলাদেশের জয়টি সহজ করার ক্ষেত্রে বিধ্বংসী মুশফিককেও মনে করিয়ে দিয়েছেন ওই ভক্ত। ১২ বলে যখন ১৬ রান দরকার ছিল, তখন ভারতীয় পেসার প্রবীন কুমারকে টানা দুই বলে চার ও ছক্কা হাঁকিয়ে টার্গেট একদম নাগালের মধ্যে নিয়ে আসেন মুশফিকই। অবশ্য এই সুযোগে ইরফান পাঠানের করা এর আগের ওভারটির কথাও উল্লেখ না করলেই নয়। ১৮ বলে দরকার ছিল ৩৩ রানের আর সেই সময়ে বাঁহাতি পেসারকে টানা দুই বলে মারা ছক্কাও টার্গেট সাধ্যের মধ্যে নামিয়ে এনেছিল। এরপর জেতার জন্য ঠোঁট আর চায়ের কাপের যে দূরত্বটা ছিল, সেটি অশোক দিন্দাকে মারা বাউন্ডারিতে ঘুচিয়েছিলেন মাহমুদ উল্লাহ।
ভক্তের ভিডিওতে যেখানে মুশফিকের একটি ইনিংস মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে মাহমুদ উল্লাহর একাধিক। এর মধ্যে একটি ইনিংস ৪২ বলে অপরাজিত ২১ রানের মাত্র কিন্তু কার্যকারিতায় যে সেটি সেঞ্চুরির চেয়েও বেশি! চট্টগ্রামে ২০১১-র বিশ্বকাপ ম্যাচে ইংল্যান্ডের ২২৫ রান তাড়া করতে নামা বাংলাদেশ ১৬৯ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে তো হারের পথেই ছিল। কিন্তু সেখান থেকে পেসার শফিউল ইসলামকে নিয়ে নবম উইকেটে মাহমুদ উল্লাহর অবিচ্ছিন্ন ৫৮ রানের পার্টনারশিপেই মাস্টারদা সূর্যসেনের শহরে ‘ব্রিটিশ বধ’ করা গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। ২০১৫-র বিশ্বকাপেও সেই ইংলিশদের হারিয়েই প্রথমবারের মতো টাইগারদের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা নিশ্চিত হয়েছিল মাহমুদ উল্লাহর সেঞ্চুরিতে। ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম বাংলাদেশি সেঞ্চুরিয়ান নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও ছুঁয়েছিলেন তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার। যে ইনিংসে আরেকটু হলে টুর্নামেন্টের ফাইনালিস্ট কিউইদেরও হারিয়ে দিচ্ছিলেন সাকিব আল হাসানরা!
অবশ্য ভক্তের ভিডিও দেখে দুজনেরই একই রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে ধরে নেওয়ার ভুল ধরা পড়তেও সময় লাগল না। গতকাল সকালে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে মাহমুদ উল্লাহর এ কথায় হেলদোলই নেই কোনো, ‘হ্যাঁ, মুশফিক আমাকে ভিডিওটি দেখিয়েছে।’ দেখে মুশফিক সান্ত্বনা পেলেও তাঁর ভায়রা ভাইয়ের অন্তর্দহন যে কমেনি, সেটি বুঝে নিতেও সমস্যা হয়নি, ‘আমি আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না যে ভিডিওটি দেখে স্বস্তি পেয়েছি কী পাইনি!’ ড্রাইভারের কাছ থেকে গাড়ির চাবি বুঝে নিয়ে নিজেই ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ার আগে স্বীকারও করে গেলেন যে ভেতরটা পুড়ে এখনো খাক হয়ে চলেছে তাঁর, ‘আমি আসলে এখনো খুব আপসেট। ব্যাপারটি একদমই ভুলতে পারছি না।’
ম্যাচ জেতানো অনেক ইনিংসের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার পরও পারছেন না যখন, তখন মাহমুদ উল্লাহর কষ্টের পরিমাপও খুব কঠিন কিছু নয়!