কালকের ম্যাচ দেখে দুই রকম অনুভূতিই হলো। চোট থেকে ফিরে মুস্তাফিজ নিজেকে কীভাবে অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেটা দেখলাম। আর দেখলাম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং বিপর্যয়।
বিশ্বকাপে আমাদের পারফরম্যান্সের সার্বিক মূল্যায়নে মুস্তাফিজকে ফিরে পাওয়াটা ওপরের দিকেই থাকবে। চোটের মধ্যে থাকায় তাঁর খেলা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও সেটা উড়ে গেছে শেষ তিন ম্যাচে। তাঁর বোলিং নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনের আলোচনাগুলো সানন্দে শুনি। এই বাঁহাতি পেসার দিনে দিনে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্পদে পরিণত হচ্ছে। তাঁর যত্নটাও তাই একটু বেশি হতে হবে। মুস্তাফিজ আইপিএলে খেলবেন, ইংল্যান্ডে খেলবেন। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে যেন তিনি অল্পতেই শেষ না হয়ে যান, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
ইডেন গার্ডেনের উইকেট কাল একটু শ্লথ মনে হয়েছে। নিউজিল্যান্ড আগে ব্যাটিং নেওয়ার পরই বোঝা যাচ্ছিল বাংলাদেশের জন্য কাজটা কঠিন হবে। ১৪৬ রানের লক্ষ্য দেওয়ার পর তো সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। আমাদের ব্যাটসম্যানরাও জোর করে শট খেলতে গিয়ে একের পর এক আউট হলেন। তবে উইকেট এত দ্রুত শুকিয়ে যাবে ভাবিনি। ফাইনালের আগেই টি-টোয়েন্টি মেজাজ হারিয়ে ফেলেছে উইকেট। এ রকম হলে বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলো দেখা বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
স্পিনসহায়ক উইকেটে আট ব্যাটসম্যান নিয়ে না খেলে সাকলাইন সজীবকে খেলালেই বোধ হয় ভালো হতো। প্রতিপক্ষের কথা চিন্তা না করে নিজেদের শক্তির জায়গা নিয়ে ভাবা উচিত ছিল। অবশ্য এটাও ঠিক, সাকিব ওই এলবিডব্লুটা থেকে বঞ্চিত না হলে দৃশ্যপট অন্য রকম হতে পারত। আম্পায়ারের কেন মনে হলো ওটা এলবিডব্লু নয়, আমি বুঝিনি। সাকিবও নিশ্চিত উইকেট থেকে বঞ্চিত হওয়ার হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। নয়তো উইকেট নেওয়ার কাজে মুস্তাফিজের সঙ্গে তিনিও হাত লাগাতে পারতেন।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এবার অনেক দলকেই লেগ স্পিনার খেলাতে দেখলাম। আমাদের হাতেও যেহেতু একজন ভালো লেগ স্পিনার আছেন, আমার মনে হয় ভবিষ্যতে আমরাও সেভাবে ভাবতে পারি। জুবায়ের হোসেনকে শুধু দলের সঙ্গে না রেখে কীভাবে তাঁর কাছ থেকে সর্বোচ্চটা বের করে নেওয়া যায়, সেদিকে কোচের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
আরেকটা কথা বলা জরুরি। অনেক সময়ই দেখছি, ১৫ জনের দল নিয়ে কোচ এবং নির্বাচকদের মধ্যে বড় মতপার্থক্য থাকছে, যেটার প্রভাব একাদশেও পড়ে। আমার পরামর্শ, অন্তত হোম সিরিজগুলোয় আমরা ১২ সদস্যের দল নিয়ে খেলব। পরে প্রয়োজন পড়লে যে কাউকে ডেকে নেওয়া যাবে। প্রয়োজন না হলে জাতীয় দলের বাইরের খেলোয়াড়েরা ঘরোয়া ক্রিকেট বা অন্য খেলা খেলবেন। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটে এই রীতি আরও আগেই চালু হয়েছে।
এই বিশ্বকাপের আরেক প্রাপ্তি তামিমের ধারাবাহিকভাবে ভালো ব্যাটিং করা। কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উত্তেজিত না হয়ে খেললে তিনি আরও ভালো করতেন। স্ট্রোক খেলে অভ্যস্ত সাব্বিরও আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারলে ভালো ফল পেতেন। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে মাহমুদউল্লাহর নিয়মিত রান পাওয়াটা ভালো লক্ষণ। তবে ফিল্ডিংয়ে উন্নতির জায়গা অনেক। এই জায়গায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো দরকার। অল্প বয়স থেকেই ক্রিকেটারদের কীভাবে ভালো ফিল্ডার হিসেবে গড়ে তোলা যায়, শীর্ষ পর্যায়ের কোচরা সেই পরামর্শ দিতে পারেন বয়সভিত্তিক কোচদের।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এ রকম অনেক হোমওয়ার্কেরই সুযোগ করে দিয়েছে। লিটন দাসের মতো কারও জন্য দলে জায়গা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে এ ধরনের ক্রিকেটে মিঠুন কতটা কার্যকর, সেটাও ভাবার দরকার আছে। তিনি নিঃসন্দেহে ভালো ব্যাটসম্যান। কিন্তু দলে তাঁর কার্যকারিতা কী? নিচের দিকে বড় শট খেলার মতো ব্যাটসম্যানের অভাব বোধ করেছি আমরা।
স্পিন আক্রমণ দুর্বল হয়ে পড়াও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোহাগ গাজীর মতো বিশেষজ্ঞ স্পিনারদের দলে ফেরাতে হবে। টেস্ট বোলার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া তাইজুলকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের জন্যও প্রস্তুত করা যেতে পারে। এখন তো সাকিব ছাড়া বিশেষজ্ঞ স্পিনার একজনও নেই!
বিশ্বকাপের জন্য আমরা একটা সঠিক টিম কম্বিনেশন তৈরি করতে পারিনি বলেও মনে হয়েছে। কোনো ম্যাচের একাদশকেই আমার কাছে সেরা একাদশ মনে হয়নি। কিছু খেলোয়াড়ের প্রতি কোচের দুর্বলতা আছে বলে মনে হচ্ছে। এটা দূর করতে হবে।
তাসকিন-সানির বোলিং অ্যাকশন অবৈধ ঘোষণা হওয়াটা সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল। আমাদের প্রতি এখানে কোনো অবিচার হলেও হতে পারে। তবে এটাও ঠিক, নিজেদের দুর্বলতার কারণেই আমাদের কিছু বোলার সন্দেহজনক অ্যাকশন নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এর আগে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। কাজেই বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই এই দিকে নজর দেওয়া উচিত।
সবশেষে আমি বাংলাদেশ দল এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানাতে চাই। সত্যি বলতে কী, দুই মাস আগেও ভাবিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমাদের ছেলেরা এত ভালো খেলবে। কিছু ভুলত্রুটি সব সময়ই থাকে। সেসব সংশোধন করে বাংলাদেশ দল ভবিষ্যতে আরও বড় সাফল্যের দিকে হাঁটবে, সেটাই প্রত্যাশা।