পৃথিবীজুড়ে গড়ে ওঠা তিলোত্তমা নগরীগুলোর রূপ-লাবণ্যে শ্রমিকের কৃতিত্বই অগ্রগণ্য। কল-কারখানা থেকে নিয়ে সুবিশাল ইমারত, ফসলের মাঠ পর্যন্ত সব কিছুতেই শ্রমিকের মমতার হাত। কিন্তু শত আক্ষেপ! সভ্যতার কারিগর এ শ্রেণিটি সর্বদা উপেক্ষিত, অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিতই থেকেছে। উদয়াস্ত শ্রম অব্যাহত রেখে তিল তিল করে যে শ্রমিক মালিকের অর্থযন্ত্রটি সচল রাখে, সেই মালিকের অবিচারেই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে তার জীবন। শ্রমিক কষ্ট করে সুবিশাল অট্টালিকা তৈরি করলেও তাতে নেই তার সামান্য ঠাঁই। তাকে থাকতে হয় গাছতলায়। শ্রমিকদের ওপর হাজার বছর ধরে চলা লাঞ্ছনার অধ্যায়ের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটেছে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাত ধরে। মানবতার পরম বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.) শ্রমিক নির্যাতনের সাইক্লোন থামিয়ে দিয়েছেন কঠোর হস্তে। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণেও বাদ পড়েনি শ্রমিক। এমনকি মৃত্যু শয্যায়ও তিনি ভেবেছেন শ্রমিকদের নিয়ে। হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত্যুশয্যায় যে অসিয়ত করে যান তা ছিল—‘সাবধান থাকবে নামাজ ও তোমাদের অধীনস্থদের বিষয়ে।’ (ইবনে মাজাহ : ১/৫১৯)
আমাদের সমাজে জেলে, তাঁতি, কুমার, মুচি, মেথর, শ্রমিক, কুলি, মজুরকে আক্ষরিক অর্থে নীচু শ্রেণি মনে করা হচ্ছে। আর যখনই মুসলিম সমাজে কর্মকে ছোট করে দেখার প্রবণতা শুরু হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গেই দরিদ্রতা তাদের পেয়ে বসেছে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে কুলির কাজ করাকে অসম্মানের চোখে দেখে না অথচ নিজের দেশে শ্রমিকের কাজ করলে নাকি বংশগৌরব নষ্ট হয়। অভিভাবকরাও সন্তানকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে মেথরের কাজে পাঠাতে রাজি, কিন্তু দেশে তাকে কারিগরি শিক্ষা, শ্রম ও কর্ম শিক্ষা দিতে রাজি নয়। তাদের দৃষ্টিতে শুধু অফিসের চাকরিই বড়, তাই তো সামান্য চাকরির জন্য লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েও অফিসের ‘চাকরি’ খোঁজেন সবাই। ইসলাম এসে সব বৈধ পেশাকে সমান মর্যাদা প্রদান করেছে। কেননা সভ্যতার চাকা সচল রাখতে সব পেশায়ই লোক প্রয়োজন। একজন শিক্ষকের সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ড্রাইভার প্রয়োজন, আবার সেই ড্রাইভারের সন্তানকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য পাঠাতে হয় শিক্ষকের কাছে। তাই রাসুলে কারিম (সা.) প্রথমে কর্মের প্রতি মানুষের ঘৃণার মূলোৎপাটন করেছেন।
দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্মান ও মর্যাদা হলো নবুয়ত। নবুয়তের ওপর পৃথিবীতে আর কোনো মর্যাদা নেই। শ্রমজীবী হওয়া সত্ত্বেও নবীগণ নবুয়তের মহামর্যাদার আসনে আসীন হতে পেরেছিলেন। শ্রমিক হওয়া নবীজি (সা.)-কে বিশ্বনবী হতে বাধাগ্রস্ত করেনি। রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যত নবীই প্রেরণ করেছেন, সবাই মেষ চরিয়েছেন।’ সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও? নবীজি (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও। আমি নির্ধাতি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীর মেষ চরাতাম।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৩/৪৬৬) তিনি বিশ্বনেতা হয়েও নিজেকে শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে শ্রমিকগোষ্ঠীকে ধন্য করেছেন। তাঁর শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। শ্রমিকের জন্য অফুরন্ত সম্ভাবনার দিগন্তকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি। নিজের প্রাণাধিক প্রিয় কন্যা হজরত ফাতিমা (রা.)-কে আলী (রা.) নামের তৎকালীন পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠতম শ্রমিকের হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধাবোধ করেননি। জামাতা করেছেন। সেই শ্রমিক হয়ে গেলেন এককালের বিশ্বনেতা। দেড় হাজার বছর আগেই একজন শ্রমিক থেকে বিশ্বনেতা তথা প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেওয়া কেবল ইসলামের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। তাঁর সমাজসংস্কার এমন এক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল, যার ফলে অহেতুক অহমিকার সব সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত ও ইমামগণও তাঁদের নিজেদের মূল নামের পাশাপাশি পেশাভিত্তিক পরিচয় দিতে বিন্দুমাত্রও লজ্জাবোধ করতেন না। ‘আত্তার’—অর্থাৎ আতর বিক্রেতা, কাত্তান (তুলা উৎপাদনকারী), খাব্বাজ (রুটি ব্যবসায়ী) ইত্যাদি পেশাভিত্তিক উপাধি ব্যবহার করতেন তাঁরা।
বৈধ কোনো পেশাই ছোট নয়—এই বাণীর মাধ্যমে কর্মের প্রতি মানুষের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কারোর নিজ পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করা কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। তাকে (প্রার্থীকে) সে কিছু দিক বা না দিক।’ (বুখারি : ২/৭৩০) ভিক্ষার প্রতি নিরুৎসাহিত করে ভিক্ষার হাতগুলোকে শ্রমিকের হাতে রূপান্তর করেছেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হবে যে সে কখনো ভিক্ষা করবে না, তার জান্নাতের ব্যাপারে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করব।’ (আবু দাউদ : ২/৪২৭) উপার্জনের জন্য শ্রমে লিপ্ত থাকাকে তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ বলে উল্লেখ করেছেন। এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ দিয়ে গমন করলে সাহাবায়ে কেরাম লোকটির শক্তি, স্বাস্থ্য ও উদ্দীপনা দেখে বলতে লাগলেন, এই লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে থাকত! রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘লোকটি যদি তার ছোট ছোট সন্তান অথবা তার বৃদ্ধ মাতা-পিতার জন্য উপার্জন কিংবা নিজেকে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে, তাহলে সে আল্লাহর পথেই রয়েছে।’ (হাইসামি : ৪/৩২৫) শ্রমিকের জন্য ক্ষমাপ্রাপ্তির ঘোষণাও করেছেন তিনি। একটি হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি শ্রমজনিত কারণে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যা যাপন করে, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে।’ (তাবরানি; ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃষ্ঠা-০২) একজন শ্রমিকের জন্য এর চেয়ে আশার বাণী আর কী হতে পারে!
শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যথাযথ মজুরিপ্রাপ্তি। মালিকগোষ্ঠী বরাবরই বিভিন্ন অজুহাতে শ্রমিকদের টাকা মেরে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। ইসলামের ঘোষণা হলো, যারা শ্রমিকের পাওনা দিতে টালবাহানা করবে, হাশরের ময়দানে আল্লাহ নিজেই তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমি কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিপক্ষ। আর আমি যার প্রতিপক্ষ, তাকে পরাজিত করবই। তন্মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে, অতঃপর তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে নেয় কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না।’ (বুখারি : ২/৭৭৬) শ্রমিকের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধের ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর মতো এত কঠোর হুঁশিয়ারি আর কেউ উচ্চারণ করেননি। অনতিবিলম্বে মজুরি প্রদান করার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে আন্তরিক। মজুরির প্রশ্নে মানবসভ্যতার ইতিহাসে শীর্ষে অবস্থান করছে তাঁর বাণী। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও।’ (ইবনে মাজাহ : ২/৮১৭) মজুরির পক্ষে বিশ্বময় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হওয়া তাঁর এই বাণী বাস্তবায়িত হলে এক দিনের জন্যও শ্রমিকদের কান্না শুনতে হতো না পৃথিবীবাসীকে।
সভ্যতার এ সময়েও পত্রিকার পাতা খুলতেই শ্রমিক নির্যাতনের খবর ভেসে ওঠে। কল-কারখানার শ্রমিক তো বটেই, গৃহের শ্রমিকও বাদ যাচ্ছে না নির্যাতন থেকে। ঠুনকো অভিযোগে শ্রমিককে মারধর করার অধিকার কিছুতেই দেয়নি ইসলাম। হজরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি আমার চাকরকে মারধর করছিলাম। আমি পেছন থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, ‘সাবধান আবু মাসউদ! তুমি তোমার গোলামের ওপর যতটুকু ক্ষমতা রাখো, আল্লাহ তোমার ওপর এর চেয়ে বেশি ক্ষমতা রাখেন।’ আমি পেছনে ফিরে দেখি, তিনি আমার প্রাণের নবী। আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি তাকে আল্লাহর জন্য আজাদ করে দিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, তুমি যদি তাকে মুক্ত না করতে তবে অবশ্যই তোমাকে আগুনে জ্বলতে হতো। (মুসলিম : ৫/৯২) একজন কেনা গোলামের গায়ে হাত তোলায় নবীজি (সা.) কত বড় ধমক দিলেন! শ্রমিক কোনো ভুল করে ফেললেও তার জন্য ক্ষমার দরজা খোলা রেখেছে ইসলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এক লোক এসে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! শ্রমিককে কতবার ক্ষমা করব? নবীজি চুপ থাকলেন। লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করলে নবীজি (সা.) চুপ থাকলেন। লোকটি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলে নবীজি (সা.) বললেন, ‘প্রতিদিন ৭০ বার হলেও তার অপরাধ ক্ষমা করবে।’ (আবু দাউদ : ২/৭৬৩)
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ
বোর্ড বাজার, গাজীপুর