ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানবজাতির মধ্যে প্রচলিত সব ধরনের অন্যায়-অনাচার, অনিয়ম, হিংসা-বিদ্বেষ, সংঘাত ও রক্তপাত বন্ধের জন্য এবং মানবজাতির মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীতে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে। পৃথিবীতে মানবজাতির আগমনের পর থেকে বিভিন্ন সময় তারা এক সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ পাককে ভুলে নানা প্রকার অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। মানবজাতির মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুগে যুগে পথভ্রষ্ট জাতির মধ্যে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বা নবী-রাসুলগণ আগমন করেন।
সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যেসব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা মানবজাতির জন্য অনুকরণীয়। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এমন একটি সময় আরব ভূমিতে আগমন করেছিলেন, যখন সেখানে কোনো আইনের শাসন ছিল না এবং অজ্ঞতা, বর্বরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ছিল নিত্যমৈত্তিক ব্যাপার। সমাজে নারীদের অবস্থা আরো খারাপ ছিল। দারিদ্র্যের ভয়ে কন্যা সন্তানকে তারা জীবন্ত কবর দিত। আরবের এমন অজ্ঞতা ও অন্ধকার যুগে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের মহান বাণী প্রচার করেন এবং আরব ভূমির সব নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন।
মানবাধিকার সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত
► নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল। (সুরা মায়েদা : ৩২)
► তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না। (সুরা বাকারা : ১২৮)
► তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে করবে। (সুরা নিসা : ৫৮)
► নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমনি আছে তাদের পুরুষদের। (সুরা বাকারা : ২২৮)
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)
মহানবী (সা.) তাঁর জীবনে কয়েকটি কর্মের মাধ্যমে জাতি, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। এ-সংক্রান্ত কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।
হিলফুল ফুযুল : জাহেলি যুগের রক্তপাত, অন্যায় ও অনাচার বালক মুহাম্মদ (সা.)-এর মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি সমাজের সব অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার জন্য সর্বদা চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অবশেষে তাঁর মনে একটি অভিনব চিন্তার উদয় হলো। ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি সমমনা নিঃস্বার্থ কিছু উৎসাহী যুবক ও পিতৃব্য যুবাইরকে নিয়ে একটি শান্তিসঙ্ঘ গঠন করেন। এ সংগঠন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে পরিচিত। এ সংগঠন সমাজের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এর কর্মসূচিগুলো ছিল নিম্নরূপ—দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা; বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সদ্ভাব ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করা; অত্যাচারিতকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করা; দুর্বল, অসহায় ও এতিমদের সাহায্য করা; বিদেশি বণিকদের জান ও মালের নিরাপত্তা বিধান করা—সর্বোপরি সব ধরনের অন্যায় ও অবিচার অবসানের চেষ্টা করা।
মদিনা সনদ : মহানবী (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলে সেখানকার অধিবাসীরা তাঁকে মদিনা প্রজাতন্ত্রের সভাপতি নির্বাচিত করেন। মদিনায় তখন মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিকসহ অসংখ্য সম্প্রদায় ও গোত্রের লোক বাস করত। এসব জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি মদিনা সনদ নামে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। এ সনদের প্রতিটি ধারায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি ছিল। এর উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে—
► মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিকসহ সব সম্প্রদায় একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে এবং সব সম্প্রদায় সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।
► হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবগঠিত মদিনা প্রজাতন্ত্রের সভাপতি হবেন এবং পদাধিকারবলে তিনি মদিনার সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রধান কর্তা হবেন।
► এ সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো সম্প্রদায় শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে সমবেত শক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।
► প্রত্যেকের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
► সনদে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ জন্য তাঁর সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না।
► মদিনা নগরী আক্রান্ত হলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সবাই যুদ্ধ করবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ ব্যয়ভার বহন করবে।
► মদিনা নগরীকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হলো এবং এখানে রক্তপাত, হত্যা, বলাত্কার ও অপরাধমূলক কাজ নিষিদ্ধ করা হলো।
► দুর্বল ও অসহায়কে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
► অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সব ধরনের পাপী ও অপরাধীকে ঘৃণার চোখে দেখতে হবে।
► নিজেদের মধ্যে অন্তর্বিরোধ দেখা দিলে হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তা মীমাংসা করে দেবেন।
বিদায় হজের ভাষণ : মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের আগে তিনি সর্বশেষ যে হজ পালন করেন (৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) সেটি বিদায় হজ নামে পরিচিত। এ হজের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আরাফাতের পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশে তিনি একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। এ ভাষণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত। মহানবী (সা.)-এর এ ঐতিহাসিক ভাষণের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বাণী তুলে ধরা হলো—
► হে ভক্তগণ, তোমাদের সহধর্মিণীদের ওপর তোমাদের যেরূপ অধিকার রয়েছে, তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার তদ্রূপ। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং তাঁর আদেশমতো তাদের তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ। তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে।
► সর্বদা অন্যের আমানত হেফাজত করবে ও পাপকার্য এড়িয়ে চলবে।
► আইয়ামে জাহেলিয়া যুগ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরব জাতির ‘রক্তের বদলে রক্ত’নীতি এখন থেকে নিষিদ্ধ হলো।
► আইয়ামে জাহেলিয়াতের কুসিদপ্রথা বা সুদ নেওয়া রহিত হলো।
► দাস-দাসিদের সঙ্গে তোমরা হূদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করবে। তাদের নির্যাতন করার কোনো অধিকার তোমাদের নেই। তোমরা যা আহার করো, যে বস্ত্র পরিধান করো, তাদেরও অনুরূপ খাদ্য ও বস্ত্র দান করবে। তারা যদি ক্ষমার অযোগ্য কোনো ব্যবহার করে, তা হলেও তাদের মুক্তি দান করবে। স্মরণ রেখো, তারাও আল্লাহর সৃষ্ট ও তোমাদের মতো।
► হুঁশিয়ার, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকেও অংশীদার করবে না, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে না এবং কখনো ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না।
► হে মানুষগণ, আমার বাণী মনোযোগসহকারে অনুধাবন করতে চেষ্টা করো। স্মরণ রেখো, সব মুসলমান পরস্পরের ভাই ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। সমগ্র দুনিয়ার সব মুসলিম একই অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ। অনুমতি বাদে কেউ কারো কোনো কিছু জোর করে কেড়ে নিতে পারবে না।
► স্মরণ রেখো, বাসভূমি ও বর্ণনির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমান সমপর্যায়ভুক্ত। আজ থেকে বংশগত কৌলীন্যপ্রথা বিলু্প্ত হলো। সে-ই তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন, যে স্বীয় কাজের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে।
► সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। এ বাড়াবাড়ির ফলে অতীতে বহু জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
► হুঁশিয়ার! নেতৃত্বের আদেশ কখনো লঙ্ঘন কোরো না। যদি কোনো ক্রীতদাসকেও তোমাদের আমির করে দেওয়া হয় এবং সে যদি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের চালনা করে, তবে অবনত মস্তকে তার আদেশ মেনে চলবে।
কুসংস্কার দূরীকরণ ও শিশুর মর্যাদা
প্রতিষ্ঠা : ইসলামের আবির্ভাবের আগে আরবে দারিদ্র্য ও লজ্জার ভয়ে শিশু কন্যা হত্যার প্রচলন ছিল। মুহাম্মদ (সা.) শিশু কন্যা হত্যার এ জঘন্য প্রথা বন্ধ করেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের শিশুদের হত্যা কোরো না।’ তিনি নারীদের সামাজিক মর্যাদা দানের জন্য কন্যা সন্তানের জন্মকে অভিশাপ হিসেবে না দেখার জন্য আরববাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার প্রথম সন্তান মেয়ে।’ আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ গঠনের সুনাগরিক। তিনি সব শিশুকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
আধুনিক যুগে মানবাধিকার : পাশ্চাত্য সভ্যতায় মানবাধিকারের ধারণাটি প্রথম জন্ম হয় ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এর ফলে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে সর্বপ্রথম ঘোষিত হয় Declaration of the People’s Right এবং ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সংযোজিত হয় The Bill of Rights. এর পর থেকে মানবাধিকারের ধারণাটি সমগ্র পাশ্চাত্য দেশে বিকশিত হয় এবং ধীরে ধীরে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবাধিকার প্রসঙ্গটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকে। এর ফলে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ৩০টি ধারাসংবলিত সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয়। এ ঘোষণায় বিশ্ববাসীর মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদটি কোনো রাষ্ট্রের ওপর বাধ্যতামূলক করা না হলেও ক্রমান্বয়ে তা বিভিন্ন দেশে অনুসৃত হতে থাকে। আজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গঠিত হয়েছে মানবাধিকার কমিশন। এসব কমিশন নিজ নিজ দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি আজ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যেন ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পৃথিবীর সর্বত্র ক্রমাগত ঘটেই চলছে। আজকের আধুনিক সভ্য যুগে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারকে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে মহানবী (সা.) অজ্ঞতা ও অন্ধকার যুগে কলুষিত সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শতভাগ সফল হয়েছিলেন।
মুসলমানরা উত্তর আফ্রিকায় সাম্রাজ্য বিস্তার করলে সেখানকার বারবার জাতির মতো দুর্ধর্ষ ও হিংস্র জাতির মধ্যেও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা স্পেন বিজয় করলে ইউরোপ ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত সামন্ত রাজাদের দুঃশাসন ও অত্যাচারের হাত থেকে সেখানকার সাধারণ মানুষ মুক্ত হয়। তারা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
এ ছাড়া মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্ণবাদ ও কুসংস্কার দূরীকরণেও ইসলামের ভূমিকা অপরিসীম। অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম যখন যেখানে বিস্তৃত হয়েছে, সেখানেই সব অনাচার, কুসংস্কার, বৈষম্য ইত্যাদি দূরীভূত হয়েছে এবং মানুষ তাঁর ন্যায্য অধিকার ভোগ করেছে। ইসলামই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সফলতা লাভ করেছে। আজও ইসলামী রীতিনীতি অনুসরণ ও পালনের মাধ্যমেই পৃথিবীর বুকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,সরকারি বাঙ্লা কলেজ, ঢাকা