স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৩। বিস্মৃতির অতলে লুকিয়ে থাকা সত্য হলো—বাংলা সনের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য। ‘সন’, ‘তারিখ’ আরবি শব্দ আর ‘সাল’ ফারসি শব্দ স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলা সনের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পৃক্ততা। কেননা ইবাদতের প্রয়োজনে চান্দ্রমাসের হিসাব রাখা ফরজে কিফায়া। স্বভাবত মানুষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা স্মরণ করে সময়-তারিখ বলে; যেমন সংগ্রামের বছর, বড়পানি বা বন্যার বছর, আকালের বছর। আবিসিনিয়ায় আবরাহার হস্তীবাহিনী ধ্বংস হওয়ার ফলে চালু হয় ‘হস্তীবর্ষ’। ইতিহাসে দেখা যায় বিশেষ ঘটনাকেন্দ্রিক সন ব্যবস্থার প্রচলন। যেমন—হজরত ঈসা (আ.)-এর স্মরণে খ্রিস্টবর্ষ। প্রিয় নবী (সা.)-এর হিজরতের ঘটনার ১৭ বছর পর হজরত ওমর (রা.) হিজরি সন প্রবর্তন করেন।
বাংলা নববর্ষ পালনে ইরান ও আরবের বিভিন্ন দেশের নববর্ষ উদ্যাপন ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের যোগসূত্র লক্ষণীয়। ১২০১ খ্রিস্টাব্দ, ৫৯৮ হিজরি মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের ফলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়। তখন চান্দ্র ও সৌরবর্ষের গণনারীতিতে পার্থক্যে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। কারণ সূর্য নিজ কক্ষপথে ঘুরতে সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। যা হলো সৌরবর্ষ। আবার চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধিতে সময় লাগে প্রায় ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা। যে কারণে এক চান্দ্রবছর হতে সময় লাগে প্রায় ৩৫৪ দিন ৮ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট।
মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে ‘উশর’ ও ‘খারাজ’ তথা মুসলমানদের ফসলি কর ও অমুসলিমদের ভূমি কর আদায়ের ক্ষেত্রে চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের গণনারীতির ব্যবধানে তৈরি হয় জটিলতা। কেননা ওই দুই বর্ষপরিক্রমায় তৈরি হয় ১১ দিন ব্যবধান এবং ৩৩ বছরে পার্থক্য হয় এক বছর! বাস্তবে দেখা গেল, হিজরি সালের হিসাবে যখন কর আদায়ের সময়, তখন কৃষকের মাঠে ফসলও থাকত না।
‘মুসলিম ফসলি সন’ প্রবর্তনের আগে অগ্রহায়ণ থেকে বছর গণনা হতো। ‘অগ্র’ অর্থ শুরু, ‘হায়ণ’ অর্থ বছর। অন্য মতে, ‘অগ্র’ অর্থ শ্রেষ্ঠ, ‘হায়ণ’ অর্থ ধান। কেননা এ সময় প্রধান ফসল আমন বা শ্রেষ্ঠ ‘হৈমন্তিক’ ধান কৃষকের ঘরে ওঠত। তবে বর্ষা শেষে খাজনা আদায়কারী কর্মচারীদের অসুবিধা বিবেচনায় তা শুষ্ক মৌসুমে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে সম্রাট আকবরের সভাসদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি একটি নতুন সৌর সন উদ্ভাবন করেন। তিনি হিজরির ৩৫৪ দিনের পরিবর্তে ৩৬৫ দিন ধরে যে নতুন সন উদ্ভাবন করেন, তা-ই ‘বাংলা সন’ হিসেবে প্রচলিত। সম্রাট আকবর ফরমান জারির মাধ্যমে এই নতুন সন গণনা করেন এবং সূচনা বছর হিসেবে ধরা হয় তাঁর মসনদে আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, ৯৬৩ হিজরিকে। দেখা যায়, আকবরের ‘ফসলি সন’ যখন চালু হয়, তখন সুবে বাংলায় মহররমে ছিল বৈশাখ মাস। সে জন্যই নতুন সনের প্রথম মাস হয়ে গেল বৈশাখ মাস। অন্যদিকে চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষের গণনারীতির ব্যবধানে কালের বিবর্তনে দেখা যাচ্ছে এখন হিজরি ১৪৩৭ এবং ১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ পহেলা বৈশাখ ১৪২৩ সাল। এ থেকে জানা যায়, আমাদের বাংলা নববর্ষে ঐতিহাসিক হিজরত ও হিজরি সনের স্মৃতি মিশে আছে।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ‘যুক্তফ্রন্ট সরকার’ ক্ষমতায় এলে এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন এবং দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। বঙ্গাব্দের সূচনা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ঠিক রাখার জন্য বাংলা একাডেমির পক্ষে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বছরের শুরুর পাঁচ মাস ৩১ দিন এবং শেষ মাসগুলো ৩০ দিন নির্ধারণ করেন এবং আশির দশকে বাংলা একাডেমি ৮ ফাল্গুন ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ঠিক রাখার জন্য খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে মিলিয়ে অধিবর্ষ নির্ধারণ করে ফাল্গুন মাস ৩১ দিন প্রচলন করেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে সাংবাদিক বোরহান আহমেদের প্রস্তাবে রমনায় ‘পান্তা-ইলিশ’ এবং ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে চারুকলার আনন্দ মিছিলকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে প্রথম প্রচলন করা হয়।
পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের এমনি উৎসব—যা ধর্ম, সমাজ, বয়স ও বৃত্তির সীমা পেরিয়ে সর্বত্র একাকার। এদিনে আমাদের করণীয় হলো—নববর্ষকে আল্লাহর নিয়ামত মনে করে শুকরিয়া আদায় করা। নববর্ষের আনন্দ দুস্থ-দরিদ্রদের সঙ্গে ভাগ করা। নববর্ষে অভাবী মানুষের খোঁজ-খাতির, তাদের খাদ্য, পোশাক দান করা। পহেলা বৈশাখ নতুন আঙ্গিকে জীবন গড়ার শপথের দিন। পহেলা বৈশাখ রাষ্ট্রীয় কর পরিশোধের অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। পহেলা বৈশাখ দেনা-পাওনা ঁঢ় ঃড় ফধঃব বা হালনাগাদ করার দিন। পহেলা বৈশাখ পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির প্রেরণার দিন। ফসলি কর পরিশোধের সঙ্গে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাবোধ জাগানোর দিন হতে পারে।
ইসলামে নির্দোষ বিনোদন, উত্পাদনমুখী তত্পরতা সমর্থিত। পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ ‘হালখাতা’। উদ্দেশ্য ছিল ‘উশর’, ‘খারাজ’ বা ফসলি কর পরিশোধের আনন্দ প্রকাশ করা এবং ব্যবসায়ের হিসাব ও খাজনা ‘রাজকীয় খাতায় হালনাগাদ’ বা ঁঢ় ঃড় ফধঃব রাখা। এ উপলক্ষে রাজা-জমিদারকে প্রজারা তাদের সৃজনশীল পণ্য, সূচিকর্ম উপহার দিত। রাজা-জমিদাররাও প্রজাদের ‘কর রেয়াত’ ও ‘ইনাম’ দিতেন। মানুষের নৈপুণ্য প্রদর্শন ও সাংবাৎসরিক প্রয়োজনীয় অথবা শৌখিন পণ্যের বেচাকেনার জন্য বৈশাখী মেলা লোকবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। মেহনতি কৃষক খাজনা আদায়ের আগ্রহে বলত, ‘আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি…’; কিন্তু বর্তমানে তা হয়েছে এক দিনের সস্তা বিনোদনসর্বস্ব বিষয়। নববর্ষের গর্বিত অতীত ভুলে পালিত হয় শহুরে ঘরানায়। এতে নেই মেঠো বাঙালির ‘সোনা ছোঁয়া মাটির’ সৌরভ। বরং ব্যান্ড ও ব্র্যান্ডিংয়ের কল্যাণে বসছে বাণিজ্যিক পসরা। হাড়ভাঙা শ্রমে ক্লান্ত যে কৃষক ঋণে জর্জরিত, তার কাছে বাংলা নববর্ষের আবেদন কতটুকু? অন্যদিকে খাদ্যের সঙ্গে মিশে থাকা চুল, কাঁকরজাতীয় বস্তু যেমন অখাদ্য, তেমনি সংস্কৃতির মধ্যে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশই বা কতটা যৌক্তিক? বর্তমানে তো তাই—“বোশেখ মানে—/ছোট নদীর হাঁটু জল; জমবে মেলা বটতলা হাট খলা।/উদাসী মন, পাগলা হাওয়া—/তাঁতের শাড়ি-পাঞ্জাবি, পাশাপাশি বাদাম খাওয়া।/বোশেখ মানে—আনমনে গান গাওয়া, ‘না বলা কথা’ বলে ফেলা।”
স্মরণ রাখতে হবে, উৎসবের আবহে নারী-পুরুষের অবাধ-অবাধ্য মেলামেশা ইসলামে অনুমোদিত নয়। ‘চোখের হেফাজত’ খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর নির্দেশ : ‘হে রাসুল (সা.)! মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে।’ (সুরা নুর : ৩০) পর্দা বজায় রাখা নারী-পুরুষ সবার জন্যই সার্বক্ষণিক বাধ্যতামূলক বিধান। আর বিনোদন যেন অপচয়ের কারণ না হয়, তা-ও খেয়াল রাখা জরুরি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে, তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬, ২৭)
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর