fth

মোস্তাফিজুর রহমান খেলা দেখেন না। এই যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডে হলো, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি; মোস্তাফিজ দেখেননি। কাঁধের অস্ত্রোপচারের পর পুনর্বাসন চলাকালীন তাঁর ঠিকানা বিসিবির একাডেমি ভবন। সেখান থেকে কয়েক পা এগুলোই মাঠ। তবু মোস্তাফিজের একবারও মনে হয়নি, ‘যাই, খেলাটা দেখে আসি…।’ আজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে। দুদিন আগের কথা যদি বলা হয়, এই ম্যাচটি দেখতেও মাঠে যাওয়ার পরিকল্পনা তাঁর ছিল না।
গত শুক্রবার সেন্ট যোসেফ স্কুলে কিশোর আলোর তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠান ছিল। স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার রবি পিউরিফিকেশন ও সংগীত শিল্পী তাহসানের সঙ্গে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ক্রিকেটার মোস্তাফিজ। মিরপুর থেকে সেন্ট যোসেফ স্কুলে যাওয়া-আসার পথে তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল বিস্ময়কর তথ্যটা, ‘অামি খেলা দেখতে মাঠে যাই না।’
কিন্তু কেন তিনি মাঠ-বিমুখ? তাহলে কী টেলিভিশনে খেলা দেখছেন মোস্তাফিজ?

সেটিও না। মোস্তাফিজের ভাষায়, ‌‘বড় কোনো ঘটনা হলে দেখি।’ তার আগ পর্যন্ত কি করেন? এই যে স্টেডিয়ামে দর্শকদের গগনবিদারী চিৎকার, তার থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে থেকেও কীভাবে কানে তুলো গুঁজে থাকা সম্ভব! মাঠের গর্জন শুনলে সাধারণ মানুষই ভেতরে ঢুকতে অস্থির হয়ে যায়, তিনি তো একজন স্বভাব ক্রিকেটার। রক্তে ক্রিকেট। কি করে পারেন খেলা থেকে মনটাকে ঘুরিয়ে রাখতে?

প্রথমে মনে হচ্ছিল, নিজে খেলতে পারছেন না। তাই হয়তো মনের কষ্টে আছেন। মাঠের সামনে গেলেই মনে হয়, ‘ইশ্‌, আমিও যদি নামতে পারতাম দুটো ওভার বল করতে…!’ বাস্তবে মোস্তাফিজের মধ্যে অমন কোনো আফসোস নেই। সামনে বিপিএলের প্রলোভন, একটা ম্যাচে ৩-৪ ওভার করে বল করলেই কোটি টাকার হাতছানি; তবু তিনি খেলবেন না।

ফিট নন বলে বিপিএলের ‘প্লেয়ারস ড্রাফটে’এর তালিকায় ছিলেন না। তবে আগামী সাত-আট দিন পর থেকে টেনিস বলে হালকা বোলিং শুরু করার কথা। অবস্থা ভালো মনে হলে ধীরে ধীরে ক্রিকেট বলে বোলিং অনুশীলন শুরু করবেন। আর এভাবে চলতে থাকলে বিপিএলের সেমিফাইনাল, ফাইনালের আগে মোস্তাফিজের সুস্থ হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। তাঁকে পাওয়া নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের মধ্যে বিরাট বড় বাজি হয়ে যেতে পারে তখন। কিন্তু মোস্তাফিজ এখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন, বিপিএল একদমই খেলবেন না, ‘সেমিফাইনাল বা ফাইনাল খেলতে হলে তো পুরো প্রেশার দিয়ে খেলতে হবে। কয়টা টাকার জন্য অত ঝুঁকি নিয়ে লাভ আছে? বিপিএলে খেলবই না। আমার টার্গেট নিউজিল্যান্ড সিরিজে খেলা।’

তাহলে সেই প্রশ্নটার উত্তর কী? কেন খেলা দেখেন না মোস্তাফিজ! সমস্যা কোথায়? পুনর্বাসন কাজ ছাড়া বাকি সময় স্টেডিয়াম এলাকায় থাকেন না নাকি! বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে কোথাও চলে যান?

অবাক ব্যাপার, এটাও নাকি ‘না!’ একাডেমি ভবনের চার দেয়ালের বাইরে মোস্তাফিজ খুব কমই যান। জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্প চলাকালীন মাঝে মাঝে ড্রেসিংরুমের দিকে আসতে দেখা গেছে। মাশরাফি-সাকিবদের সঙ্গে গল্প-গুজব করে আবার চলে গেছেন একাডেমি ভবনের তিন তলায় নিজের কক্ষে। বাইরে যাওয়া প্রসঙ্গে বললেন, ‘আমি কোথায় যাব? বন্ধু-বান্ধব যারা ঢাকায় আছে, ডাকলে ওরাই চলে আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আজ তো সাতক্ষীরা থেকেও একজনের মাছ নিয়ে আসার কথা। আমার কোথাও যেতে অত ভালো লাগে না।’

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের কাছেই মামার বাসা। খুব বেশি হলে সেখান পর্যন্ত যান মোস্তাফিজ। নয়তো বোনের বাসায়। দুপুর বা রাতের খাওয়া খেয়ে আবার চলে আসেন। সেটাও সপ্তাহে এক-দুদিনের বেশি নয়। বাকি দিন, বাকি সময় ঠিকানা একাডেমি ভবন। গান শোনেন। ঘুমান। আর ভাবেন, এত অল্প সময়ে কীভাবে চলে এলেন এতটা পথ!

‘জানেন, আমি প্রথম ক্রিকেট বল চোখে দেখি ২০১০ সালে। এর আগে এই বল কেমন সেটাই জানতাম না। গ্রামে টেনিস বা টেপ টেনিস বল দিয়ে খেলতাম’— এমনিতে কম কথা বলা মুস্তাফিজ যেন খোলা বই হয়ে গেলেন! যত বলেন, ততই জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প, ‘টেনিস বলে কাটার ভালো হলেও টেপ টেনিসে কাটার হয় না। কাটার নিয়ে তখন অত ভাবতামও না। এটা যে আমার একটা অস্ত্র হতে পারে, তাও তখন বুঝিনি। ঢাকায় নেটে করার পর বুঝলাম এটা বিশেষ কিছু। ক্রিকেট বলে চাইলে আরও ভালো কাটার মারা সম্ভব।’

স্মৃতি হাতড়ে চলে গেলেন তেঁতুলিয়া গ্রামে। এখন ঢাকায় না থেকে যদি বাড়ি বসে থাকতেন, কি হতো? সময় কাটত কীভাবে? ‘আমার মাছ ধরার শখ। বাড়ির আশপাশের পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরি। আপনি জানেন, মাছ কিন্তু ফলের মতো। সব সিজনে সব মাছ খেয়ে মজা নেই। যে মাছে যখন তেল আসে, সে মাছ তখন খেয়ে মজা।’ মোস্তাফিজের প্রিয় মাছ তাহলে কি? উত্তরটা মজার, ‌‘একেক সিজনে একেকটা প্রিয়। তবে রুই মাছের মাথা সব সময় ভালো লাগে।’

গ্রামে থাকলে আর তুলতে হতো ছবির পর ছবি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মানুষ আসতেই থাকত মোস্তাফিজের সঙ্গে দেখা করতে। বিরামহীন, বিশ্রামহীন। মানুষের সে ঢল সামলানোর ক্ষমতা মোস্তাফিজের নেই, তাঁদের মন খারাপ করে দিতেও ইচ্ছে হয় না। পরিচিত, অপরিচিত সবার সঙ্গেই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে যান ছবি তুলতে, ‘ছোট ছোট বাচ্চারা কত দূর থেকে চলে আসে সাইকেল চালিয়ে। ওদের কি করে ফেরাই? আমার এসব ভালোই লাগে। তবে যখন-তখন না এসে সবাই যদি সময়টা বুঝে আসে, তাহলে ভালো হয়।’

এটুকু বলতেই রাস্তার পাশে ছোট এক শিশুর ওপর চোখ পড়ল মোস্তাফিজের। শিশুটির এক পায়ের হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ব্যান্ডেজ। রিকশা বা অন্য কোনো বাহনের অপেক্ষায় তাকে কোলে নিয়ে ফুটপাথে বসে ছিলেন সম্ভবত শিশুটির বাবা। এই দৃশ্য দেখে মোস্তাফিজ হাহাকার করে উঠলেন, ‘আহারে! বাচ্চাটা ব্যথা পেয়েছে। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে ছোটদের আর বুড়োদের কষ্ট দেখলে।’

আর সবচেয়ে মেজাজ খারাপ হয় সম্ভবত রাস্তার ওপর কাউকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখলে। একটা হিউম্যান হলারকে মাঝ রাস্তায় থেমে যাত্রী নামাতে দেখে খুবই বিরক্ত হয়ে উঠলেন, ‘এদের কেউ কিছু বলে না কেন ভাই? রাস্তা দখল করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখে, তবু কিছু বলে না। কারও নিয়ম মানার ইচ্ছা নেই। আমি হলে দুই দিনে সব ঠিক করে ফেলতাম।’

পারতেন কিনা পরের প্রশ্ন, তবে আগ্রহটা তো দেখালেন! শুধু ক্রিকেটার হয়েও ক্রিকেট খেলা দেখার প্রতিই তাঁর অনাগ্রহ তাঁর। দেয়াল পেরুলেই মাঠ। তবু কেন দেখতে যান না খেলা? স্টেডিয়ামের নিরাপত্তার জাল ছিন্ন করতে অসুবিধা হয়? মোস্তাফিজ প্রতিবাদ করে বলেন, ‘না, না…আমি গেলে তো ওরা আমাকে সবচেয়ে ভালো জায়গাতেই বসতে দেবে।’

তাহলে? মোস্তাফিজ হেসে বলেন, ‘আসলে অতটা সময় বসে বসে খেলা দেখা…। একটা সময় খুব খেলা দেখতাম। যখন নিজে খেলতাম না। টেলিভিশনে অনেক খেলা দেখেছি। কোনো খেলা মিস দিইনি। এখন খেলা দেখতে অত ভালো লাগে না।’

কেন ভালো লাগে না, সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মোস্তাফিজ শুধু হাসেন। হয়তো মনে পড়ল, ‘এক দিনে তো অনেক বেশি কথা বলে ফেললাম! আর না।’