পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম মানুষের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের পাশাপাশি নারীরা এখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন কখন তারা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে সন্তান নেবেন। শুধু তাই নয়, সন্তানের পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারেও মায়েরা এখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
২০১২ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত পরিবার পরিকল্পনা-বিষয়ক সম্মেলনে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে আরও ১২ কোটি নারীর কাছে আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছানোর আহ্বান জানানোর পাশাপাশি কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ‘এফপি ২০২০’ শীর্ষক ওই লক্ষ্যমাত্রায় বেঁধে দেওয়া সময়সীমার অর্ধেক সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ২০১৬ সালে। বিশ্বে এবং বাংলাদেশে ওই লক্ষ্যমাত্রার কিছুটা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হবে।
এফপি ২০২০ লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের পথে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০৩০ সালের ওই লক্ষ্যমাত্রায় সবার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের গল্প
পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বড় সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মোট প্রজনন হার ১৯৭৫ সালে যেখানে নারীপ্রতি ৬ দশমিক ৩ ছিল, তা ১৯৯১ সালে ৪ দশমিক ৩ এবং তারপর ২০১৪ সালে ২ দশমিক ৩-এ নেমে আসে (বিডিএইচএস ২০১৪)। ১৯৭৫ সালে প্রথম জাতীয় জরিপের সময় সন্তানধারণের উপযোগী বয়সী বিবাহিত নারীদের মাত্র ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করতেন। ২০১৪ সালে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার ৬২ শতাংশে পৌঁছায়। সেই সাফল্যের ধারা বর্তমানে কিছুটা থেমে আছে বলে মনে হচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রজনন হারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ দশমিক ০। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার ৭৫ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু এখনো এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। জাতীয় জরিপ অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মোট প্রজনন হার স্থির ছিল। তবে কয়েকটি এলাকায় তা কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। চিত্রটা বাংলাদেশের একেক জায়গায় একেক রকম। মোট প্রজনন হার, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী প্রাপ্তির দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের। তবে এই তিন ক্ষেত্রেই রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অবস্থা সবচেয়ে ভালো ছিল। এখন সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের অবস্থা ভালো হতে শুরু করেছে। তবে ঢাকা বিভাগে আবার মোট প্রজনন হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার মাত্র ১ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য অন্তত ৪ লাখ ৫০ হাজার নতুন নারীকে যেকোনো পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এতে এখানে বিভিন্ন সেবা, অবকাঠামো ও পরিবেশের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটছে। এমনকি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমালেও ২০১১ থেকে ২০৬০ সালের মধ্যে দেশটিতে আরও ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষ যোগ হবে। ইউএনএফপিএর সহায়তায় ডেমোগ্রাফিক ইমপ্যাক্ট স্টাডি (ডিআইএস ২০১৫) এ তথ্য দিয়েছে। বাড়তি ওই জনসংখ্যার কারণে দেশের শ্রমবাজার প্রচুর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, নগরবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমাতে যত শিগগির সম্ভব জন্মহার কমাতে হবে। তারপরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে স্থিতিশীল করতে আরও ২০ থেকে ৩০ বছর লাগবে।
সুপারিশমালা
পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে এমন নববিবাহিত দম্পতিদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছানো
বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নারী-পুরুষের সংখ্যা তুলনামূলক কম। এ ধরনের নববিবাহিত দম্পতিদের কাছে যেতে হবে। এ ছাড়া গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত কিশোরী-তরুণী ও নারীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, তাঁদের কাছে পরিবার পরিকল্পনা সেবা পৌঁছে দেওয়াটা কঠিন। এ ছাড়া চা-বাগানে কর্মরত নারী, বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী, শরণার্থী নারী, জেলে সম্প্রদায় এবং নগরের বস্তি এলাকার নারীদের প্রতিও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে যেন তাদের কাছে সকল সেবা পৌঁছায়।
দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের হার বাড়ানো
যেসব দম্পতির ইতিমধ্যে সন্তান হয়েছে এবং আরও দীর্ঘদিন সন্তান জন্মদানে সক্ষম থাকবেন, তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী পদ্ধতিগুলো আদর্শ পদ্ধতি। এটা গর্ভধারণের হারকে বছরে ৩০ শতাংশ কমাবে। আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহণের হার অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের তুলনায় কম। দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহণের হার বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা রয়েছে ১২ শতাংশ। তারপরও প্রসব-পরবর্তী প্রথম দুই বছর পরিবার পরিকল্পনা করছেন এমন ৪৪ শতাংশ নারীর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী পদ্ধতি নেন। অথচ তাঁরা ইচ্ছে করলেই আইইউডির মতো দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। প্রসব-পরবর্তী সময়ে সেবাকেন্দ্রে গেলে যেন তাঁরা একই সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা সেবাগুলোও পান, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সমন্বিত মানসম্মত সেবা প্রদান
পরিবার পরিকল্পনা সেবাদানকারী, বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে দক্ষ সেবাকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো দরকার। সেবার গুণগত মান বজায় রাখতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা সেবা সবার নাগালের মধ্যে এবং আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে হবে। প্রত্যেকের জন্য সঠিক ব্যবস্থাটি কী হবে, সে সম্পর্কে সেবাকর্মীরা যেন গ্রাহকদের সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। ওই কর্মীরা গ্রাহকের প্রথম সন্তান দেরিতে নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেবেন এবং পরিবারপিছু শিশুসংখ্যা সীমিত রাখার উপযোগী সেবা দেবেন।
ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত