কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়াই ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের কাজ দেওয়া হলো যুক্তরাজ্যের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রেডলাইন এভিয়েশন সিকিউরিটি লিমিটেডকে। সরকার যথাসময়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় হঠাৎ করে চাপের মুখে দ্রুত এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
গতকাল সোমবার বিকেলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তরে এ ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তির আওতায় আগামী দুই বছর শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে এই ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের পক্ষে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নুরুল ইসলাম ও রেডলাইনের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পল মেসন এই চুক্তিতে সই করেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম সানাউল হক উপস্থিত ছিলেন। পরে বিমানমন্ত্রী চুক্তির বিষয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট ২০০৭ ও ২০০৯ সালে দুবার বাংলাদেশকে পণ্য পরিবহন স্থান, যাত্রী ও তাদের পণ্য তল্লাশি এবং বিমানবন্দরের কর্মরত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কী ধরনের নীতিমালা ও পদক্ষেপ নিতে হবে তা নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছিল। অথচ ওই দুটি প্রতিবেদনকে সরকার বিবেচনায় নেয়নি। এমনকি যুক্তরাজ্য নিজেদের অর্থায়নে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে বেবিচকের ৪০ জন জনবলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। তাদেরও বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে। প্রশিক্ষিত ওই লোকজন সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে যুক্তরাজ্য জানতে পারে, এদের বেশির ভাগই ঢাকার বাইরে বদলি হয়ে গেছেন চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সৈয়দপুরে। অথচ তাঁরা যে ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ বাংলাদেশের ওই তিন বিমানবন্দরে নেই।
সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় আগে থেকে ঠিকমতো কাজ না হওয়ার কারণেই আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কি না, জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তখন ছিলাম না, এ ব্যাপারে বলতে পারব না। আমি এসে গত বছর থেকে চেষ্টা করছি।’ কোনো রকম বাছবিচার না করে চাপের মুখে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের হাতে বিমানবন্দরের দায়িত্ব তুলে দিলেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এভাবে নয়, আমাদের যা করার দরকার ছিল তা আমরা করেছি।’
বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর স্থানে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়ার আগে প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের স্বচ্ছতা ছিল কি না—এ প্রশ্নের জবাবে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘এটা মন্ত্রণালয় করেনি, প্রতিষ্ঠান বাছাই করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েছে। অন্যরা প্রস্তাব দিতে পারেনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, যত দ্রুত সম্ভব অর্থাৎ ২০ মার্চের মধ্যে এটা চূড়ান্ত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে।’ মন্ত্রীর এ বক্তব্যের সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম সানাউল হক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এত টাকার কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল কি না—এ প্রশ্নের জবাবে বিমানমন্ত্রী বলেন, না, এখানে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, এ ব্যাপারে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। তাদের অনুমোদন থাকলে দরপত্রের প্রয়োজন পড়ে না।
নিরাপত্তার ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে’ ঘাটতি থাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে যুক্তরাজ্য ৮ মার্চ থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ চুক্তির ফলে এটা প্রত্যাহার হবে কি না, জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সেটা বলতে পারব না। তবে তারা যেভাবে বলছে, আমরা সেভাবেই নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন তারা নিশ্চয় সেটা বিবেচনায় নেবে।’
বিমানমন্ত্রী বলেন, চুক্তির আওতায় রেডলাইন চাইলে আজ থেকেই তারা কাজ করতে পারবে। প্রতিষ্ঠানটি তিনটি কাজ করবে। তারা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তদারক, পরামর্শকের দায়িত্ব পালন এবং বিমানবন্দরে যেসব জনবল আছে তাদের পরিচালন ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করবে। তিনি জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরামর্শক সেবার জন্য দুই বছরে রেডলাইনকে ৭৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হবে। ছয় মাস পরপর তাদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে। পরামর্শক ও তত্ত্বাবধানের কাজে ১৫ জন এবং পরিচালনার কাজে (অপারেশন) ১৪ জন রেডলাইনের পক্ষে কাজ করবে।
তবে সাবেক বিমানমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘আমাদের ব্যর্থতার কারণে বিদেশি কোম্পানি এ কাজটি করছে। আমাদের যন্ত্রপাতি ছিল কিন্তু আমরা সেটা ব্যবহার করতে পারিনি। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বমান বজায় রাখতে পারিনি, এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক।’
নিরাপত্তার ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে’ ঘাটতি থাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে যুক্তরাজ্য ৮ মার্চ থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ৩১ মার্চ দুই দেশের সম্মত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপত্তা জোরদারের কাজ শুরু না হলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে এ কথা জানান। একই দিন যুক্তরাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী ম্যাট্রিক ম্যাকলাউলিনও এসব বিষয়ে রাশেদ খান মেননের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। পরে যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েক দফা আলোচনার পর করণীয় সম্পর্কে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। সেই সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় যুক্তরাজ্য সে দেশের চারটি প্রতিষ্ঠানের একটিকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও অঙ্গীকার তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ মার্চ ডেভিড ক্যামেরনকে চিঠির জবাব পাঠান। ওই চিঠিতে দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে বিবেচনায় নিয়ে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানান। এদিকে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড গত শুক্রবার রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে ফোন করে পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।