শাশুড়ি ও ননদের সঙ্গে আমার কোনো সমস্যাই ছিল না। কারণ অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তো বারো বছর পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে আমার সামনাসামনি দেখাই হয় না। স্বামীর অ্যালবামে ছবি দেখেছি। ফোনে কথা হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু দেশে এসে গোলমাল হলো। স্বামীর টাকা-পয়সার সবই দেওয়া হতো তাঁদের। আমি ভুলেও কখনো না করতাম না, কিংবা কম দেওয়ার কথা বলতাম না। তাঁদের মন পেতে চাইলাম আমি—কিন্তু সন্দেহ-অবিশ্বাস কিছুতেই কাটছে না। তাঁদের ধারণা, আমার স্বামীর কাছে তাঁদের আরও অনেক পাওনা। সেসব থেকে আমি তাঁদের খুব ঠকাচ্ছি।’
অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে ওঠা এই বাঙালি বউটি আক্ষরিক অর্থেই কেঁদে ফেললেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘এটা কি আমাদের মানসিক সমস্যা! ছেলের বউ বা ভাবিকে বিশ্বাস করা যাবে না! কিংবা আমিও ননদকে বিশ্বাস করতে পারব না?’
এমন চিত্র নিশ্চয় সমাজের সব জায়গায় এক রকম নয়; বরং একজন নারীর তো অবশ্যই আরেকজন নারীর পাশে দাঁড়ানোর কথা। একজন মেয়ে নতুন কোনো সংসারে গিয়ে যদি সেই পরিবারের নারীদের পাশে না পান—তিনি কেমন করে মানিয়ে চলবেন?
ননদ-ভাবি টানাপোড়েন ও জটিলতা নিয়ে কম ঘটনা নেই। দোষ কার! কাকে দুষব। ননদকে নাকি ভাইয়ের বউকে।
অভিযোগ থাকে দুই তরফেই। এক পক্ষ বলছে, ননদ কেন যেন প্রথম থেকেই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব নিয়ে সংসারে কুটিল পরিবেশ তৈরিতে তৎপর। ননদের ধারণা, তাঁর এলাকায় ভাগ বসানোর লোক এসেছে। তাঁর বা তাঁদের আধিপত্য আর থাকবে না। ভাবির মত হলো, বাড়ির বউয়ের পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব কম দেওয়া হচ্ছে। ননদের ধারণা, ভাবি হঠাৎ এসে জুড়ে বসে ভাইকে বশ করে। যে ভাইকে ছোটবেলা থেকে চিনি-জানি, তার ভাবখানা এমন যে ভাইকে সে আমাদের চেয়েও বেশি চেনে।
ননদের ধারণা, ভাবি হঠাৎ এসে জুড়ে বসে ভাইকে বশ করে। যে ভাইকে ছোটবেলা থেকে চিনি-জানি, তার ভাবখানা এমন যে ভাইকে সে আমাদের চেয়েও বেশি চেনে।
আর তাতেই যত যন্ত্রণার শুরু। একাধিক সংসার বিশেষজ্ঞ শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে শুনেছি সুখের সংসারের নিগূঢ় তত্ত্ব, ‘মেয়ে বিয়ে দাও বড় ঘরে আর ছেলের বউ আনো গরিব ঘর থেকে।’ উদ্দেশ্য একটাই ঘরের বউ যেন সব সময় আতঙ্কে থাকে। গরিবের মেয়েকে ‘টাইট’ দেওয়া সহজ।
কেন এই ঈর্ষাকাতরতা?
এমন নারীর মধ্যে গভীরে কাজ করে—নিরাপত্তাহীনতা। তাই ননদ মনের অজান্তে ভাবতে থাকেন তাঁর বাড়ি আর নিজের নেই। সব ভাবির দখলে চলে যাচ্ছে। হিংসা, কূটকাচালি বাড়তে থাকে। শাশুড়ি কখনো দেখেও না দেখার ভান করেন। তবে বলা দরকার, কিছু পরিবার দেখেছি, যেখানে শাশুড়ি নিজগুণে পুত্রবধূর জন্য মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করেন। সেসব সংসারে চমৎকার ভারসাম্য রক্ষা হয়। সুখেরও হয়।
অন্যদিকে ভাবিদের নিয়ে অভিযোগ কম নয়। স্বামীর মন জুগিয়ে অনেক সময় ননদদের হিস্যাবঞ্চিত করায় তাঁরা ভূমিকা রাখেন। নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শুরুতে ঠেলাঠেলি হবেই। আর সেটাই স্বাভাবিক। ফলে উভয় পক্ষের ঠোকাঠুকি থাকবেই।
এই সমস্যার সমাধান কী?
পরিবারে সবার যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকে, তবে এই সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। এখানে মায়ের দায়িত্ব কিছুটা হলেও বেশি। তিনি তাঁর মেয়েকে মদদ দেন। কারণ বাড়িতে বউ আসায় তাঁর জায়গাটাও যে কিছুটা হলেও হেলে পড়েছে। সেটা উনি টের পান। কখনো প্রকাশ করেন আবার কখনো ভিন্নভাবে ঘুঁটি চালান দেন। এই মনোভাব বদলাতে হবে। সবার আপন জায়গাটা চিনতে ও জানতে হবে। নিজের অধিকার আদায় আর ননদ বা ভাবির প্রতি বিদ্বেষ এক কথা নয়। সচেতন মানুষকে কেউ ঠকাতে পারে না। একটা পরিবারে একজন স্ত্রীর অধিকার, সম্মান, মর্যাদা, সংসার পরিচালনায় নেতৃত্ব কখনোই ননদের অধিকারকে খর্ব করে না। দুপক্ষের মধ্যে সহনশীলতা, সমঝোতা সংসারকে মাধুর্যপূর্ণ করে তোলে।
তাই শুরুতেই যদি নিজেদের চাহিদা, দায়িত্ব-কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে বুঝে নেওয়া যায় তাতে সবার লাভ। এখানে শাশুড়ির মনে রাখতে হবে তাঁর মেয়েও একদিন অন্যের বাড়ি যাবেন। তাঁর মেয়ের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ হওয়া উচিত। সেই আচরণটাই যদি নিজের পরিবারে শুরু করেন, তবে ঝামেলা শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে। ভালো ব্যবহার করলে অবশ্যই ভালো ব্যবহার তিনি আশা করতে পারেন। যেমন অনুশীলন; তেমনই ফল।
অন্যের কন্যাকে নিজের কন্যা বলে আপন করে নিলে তাঁর কন্যাও অন্য পরিবারে কন্যার মর্যাদা পাবেন। একটি শুভ কাজ আরেকটি শুভ কাজের জন্ম দেয়।
সহযোগী অধ্যাপক
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।