অনুষ্ঠান যেমন প্রাণবন্ত হতো, শ্রোতারাও সে রকম আত্মঙ্গম করতে পারতেন, তখন বাঙালিদের মধ্যে একটা নিবিড় আত্মিক যোগাযোগ ছিল। বাঙালি সমাজের মানুষের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। যেটাকে আমরা একতা বলতে পারি। একই বোধে উদ্বুদ্ধ ছিল তারা। দেশটা ছিল পাকিস্তান। তখন ওই পাকিস্তানের চারপাশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বাঙালিরা যেভাবে তাদের প্রাণের সম্পদ, সংগীত, তাদের ঐতিহ্য, হাজার বছরের ইতিহাস—সবকিছু সামনে এনে সেগুলোকে অবলম্বন করে বাঁচতে চাইত, সেই চাওয়ার মধ্যে একটা প্রচণ্ড জোর ছিল। আর তার অত্যন্ত সুন্দর একটা প্রকাশ ছিল।
পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানগুলোতে যে গানগুলো গাওয়া হতো, সেগুলো আমাদের প্রাচীন কবিদের রচিত গান ও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছাড়াও আর যাঁরা আমাদের বড় কবি ছিলেন, গীতিকার ছিলেন—সবার গানই তালিকায় ঠাঁই পেত। আমি এই অনুষ্ঠানগুলো দেখেছি অত্যন্ত কম বয়স থেকে। মহড়া দেখেছি, অনুষ্ঠান দেখেছি। মা-বাবার সঙ্গে গিয়েছি এবং তখন মনে হতো যে এটা আমার অনুষ্ঠান, একদিন আমিও এ অনুষ্ঠানে গান গাইতে পারব। এ রকম মনে হতো। ওই সময়টা ছিল ষাটের দশকের শেষভাগে। আমার বোঝার বয়স তখনো হয়নি। এর আগে যদিও ছায়ানটের শুরু হয়েছে। তখন হয়তো আমি বুঝতে পারিনি কিছু। সে সময়টা শুরু হলো—আসলে মুক্তিযুদ্ধের একটা পটভূমি তৈরি হলো। সে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিয়ে হোক, যেভাবেই হোক। রাজনীতির একটা উত্তপ্ত অবস্থায় তখন মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিটা খুব শক্ত একটা মাটি পেল। সে রকম একটি বিশ্বাস-আস্থা ছিল বাঙালিদের মধ্যে।
মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রস্ত্ততি, সর্বময়তার ভেতর দিয়ে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান বা বাঙালির যা কিছু নিজস্ব অনুষ্ঠান—প্রতিটি অনুষ্ঠানই হতে থাকল আরও জোরের সঙ্গে, অনেক বেশি ভালোবাসার সঙ্গে আত্মবিশ্বাসী একটা ভঙিমায়। বাংলাদেশের আনাচকানাচে চলল অনুষ্ঠান আয়োজন। তখনই মুক্তিযুদ্ধের সময় এল। সে সময় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, নিত্যদিনের চলাফেরা, খাওয়া-ঘুম এসব কাজ অত্যন্ত দুরূহ ছিল। যখন-তখন মানুষ মারা যাচ্ছে। তখন কিছুটা ভাটা পড়েছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। কিন্তু আন্দোলনটা মনে দানা বাঁধছিল যেভাবে সেটার স্ফুরণ মুক্তিযুদ্ধেই ঘটে। এরপরে আমরা দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি।
ছবি: জিয়া ইসলামস্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে আমাদের সর্বজনীন উৎসবগুলো আরও দানা বাঁধতে থাকল। আরও স্বাধীনভাবে ঘটতে থাকল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত যে জীবনটা বাঙালি যাপন করেছে—মোটা চালের মোটা ভাত খেয়েছে, হয়তো মোটা কাপড় পরেছে, হয়তো রিলিফের কাপড়ও পরেছে। কিন্তু তারা মনেপ্রাণে সবকিছুতে যে স্বাধীনতা অনুভব করত, সাংস্কৃতিক যে স্বাধীন জীবনটা চিন্তা করত, যে জীবনটা তাদের অর্জিত হয়ে গেছে বলে ভাবত, সেটিতে অকস্মাৎ ছেদ পড়ল। ধীরে ধীরে দেশটা দাঁড়াবে—এই যে একটা গতি, সেটাকে একদম ঘুরিয়ে দিল ৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এরপরও হয়েছে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান। হয়নি তা নয়। ভয়ের মধ্যে ভীষণ রকমের পুলিশি পাহারার মধ্যে শুধু পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান নয়, উদীচীর অনুষ্ঠান, সবই হয়েছে। তবে বাঙালির সর্বজনীন অনুষ্ঠান, উৎসবগুলোতে কেমন যেন ভাটা পড়তে থাকল এবং সেই উৎসবগুলোতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা যেন আটকে রাখল।
দেশের রাজনৈতিক পটভূমি, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা সবকিছুই বেশ কয়েকবার পাল্টেছে। এখন যেটা বলতে পারি, এটা সব বাঙালিই জানে। তারপরও এ উৎসবগুলো এখন বাঙালির প্রাণে পৌঁছে গেছে। এটা শুধুই যে ছায়ানট, শুধুই যে কোনো সংগঠন, শুধুই যে কোনো গোষ্ঠী, এ রকম বিষয়ে আর বাঁধা থাকেনি। এটা বাঙালির প্রাণের উৎসব হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকেই যেহেতু আমি দেখেছি আমার পরিবারের মানুষ এই উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছে। তাই আমার কাছে এটি পারিবারিক উৎসব বলেই মনে হয়েছে সব সময়। আমারা চাচা-চাচিসহ (ওয়াহিদুল হক ও সানজিদা খাতুন) অনেক শিল্পীর সঙ্গে আমিও মিশে যেতাম বর্ষবরণের আনন্দযজ্ঞে। ছোটবেলা থেকেই এসব অনুষ্ঠানের সূত্রে মালেকা আজিম খান, ইফফাত আরা দেওয়ান, সেলিনা মালেক, মাহমুদুর রহমান বেনু, শাহিন সামাদসহ অনেকের ভালোবাসা পেয়েছি। কাছ থেকে দেখেছি। এরপর একটু একটু করে আমিও জড়িয়ে পড়েছি আষ্টেপৃষ্ঠে। একই বিষয় দেখেছি আমার মেয়ে জয়িতার বেলাতেও। জয়িতা ছোটবেলা থেকে এই পরিবেশ দেখেছে। এর মধ্যে দিয়েই সে বেড়ে উঠেছে। তাই ওর কাছেও এটা একান্ত নিজেদের একটি আয়োজন। শুধু পয়লা বৈশাখ না, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বসন্ত, বর্ষা বা অন্যান্য আয়োজন। সবই আমাদের পরিবারে উদ্যাপন হয় উৎসাহ নিয়ে।
এখন পয়লা বৈশাখের উৎসব রমনা বটমূলে জাতীয় পর্যায়ে সবাইকে নিয়ে যেমন হয়, তেমন বাংলাদেশের সব জেলায়, আনাচকানাচেও হচ্ছে। প্রতিটি স্কুলে হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করা হচ্ছে। এর পেছনে বাংলা ভাষা, একুশ ফেব্রুয়ারির একটা বড় অবদান রয়েছে। কোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হয়তো আগে ভাবেনি। এখন তারাও ভাবছে। তারাও পয়লা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব উদ্যাপন করছে।
আজ বাংলাদেশের চেহারায় পয়লা বৈশাখ এমন একটি মান পেয়েছে, এমন একটি জায়গায় চলে গেছে যে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে বাঙালিরা তো বটেই বিদেশিরাও আসেন এই পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে, অংশগ্রহণ করতে। এই রকম উৎসব আরও হচ্ছে বাংলাদেশে—নবান্ন উৎসব, পৌষ উৎসব, শারদ উৎসব, বর্ষা উৎসব। এগুলোও বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে, বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিভিন্ন সংগঠন ও স্কুল করছে। তো পরিবর্তন বলতে কিছু নেই। ব্যাপকতা বেড়েছে এবং একসময় স্বাধীনতার আগে মানুষ নির্ভয়ে করত। তখন ভয় থাকলেও সাহসটা তার চেয়ে শতগুণ বেশি ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে যেন সাহসটা অনেকখানি গুটিয়ে রাখতে হয়েছে। এখন আবার আশা করি দিনটা ফিরছে। এখন আবার দিনটা হয়তো বাঙালির দিন হয়ে উঠবে।
লেখক: সংগীতশিল্পী