জনপ্রিয় অভিনেতা এক সময় ছিলেন নেশাগ্রস্ততার অন্ধকারে, কেমন ছিল সেই সময়টা, কীভাবে বেরোলেন তিনি নেশার কবল থেকে, জানালেন এবেলা ওয়েবসাইটকে।
৯ বছর আগে অভিনেতা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের পুনর্জন্ম ঘটেছিল বলা যায়। নেশায় নিমজ্জিত একজন মানুষ জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, নেশা ছাড়া ভাল থাকতে হবে, অন্তত সেই চেষ্টাটা শুরু করতে হবে ‘এখনই’। আজ ২৬ জুন, আন্তর্জাতিক মাদক-বিরোধী দিবসে, কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি-ড্রাগ ক্যাম্পেনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, ‘সেলিব্রিটি’ অনিন্দ্যর বাস্তবের সঙ্গে কোথাও মেলে না সেই বাস্তব, যার মধ্যে শুধুই অন্ধকার ছিল, আলো ছিল না। সেই অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা মানুষের সঙ্গে এবেলা ওয়েবসাইটের একান্ত আলাপচারিতা জমল যখন, সেই সময়ে তিনি চলেছেন তাঁর প্রিয় কফি শপে—
কফিও তো একটা নেশা?
অনিন্দ্য: হ্যাঁ নেশা তো অবশ্যই। কারণ, ক্যাফিন একটা মুড-স্টিমুলেটিং সাবজেক্ট। কিন্তু লাভটা এটাই যে, কফি খাওয়ার জন্য আমাকে মিথ্যে কথা বলতে হয় না, চুরি করতে হয় না, রাস্তায় নামতে হয় না। আমার প্রাইমারি পারপাসটা হচ্ছে নেশা ছেড়েও যে ভাল থাকা যায়, এই বার্তাটা সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
নেশামুক্ত জীবনই তো আদর্শ। তোমার কী মনে হয়, কোন কোন ফ্যাক্টর খুব বেশি করে কাজ করে এবং নেশার দিকে ঠেলে নিয়ে যায় একটা বিশেষ বয়সে?
অনিন্দ্য: ওয়র্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন অ্যাডিকশনটাকে সেকেন্ড কিলিং ডিজিজ হিসেবে মেনে নিয়েছে। এবার আমরা যারা নেশাড়ু, আমাদেরকে খুব ছোট চোখে দেখা হয়। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যে ভাল থাকা যায়… আমি শুধু নয়, কলকাতার বুকে এখন প্রায় সাড়ে বারোশো এমন মানুষ রয়েছি আমরা যারা নেশা ছেড়ে ভাল আছি এবং পরস্পরকে সাহায্য করছি। আমি শুধু একা নয়, পৃথিবীব্যাপী উদাহরণ রয়েছে। গত তিন বছর ধরে কলকাতা পুলিশ আমাকে ইউথ আইকন বানিয়েছে, অ্যান্টি-ড্রাগ ডে-তে। আজ আমার কোনও রকম নেশার প্রয়োজন পড়ে না অথচ একটা সময়ে আমি ফুটপাথে থেকেছি, শিয়ালদা স্টেশনে পড়ে থেকেছি। আমার কাছেও এটা অবিশ্বাস্য ছিল যে, আমি নেশা ছেড়ে কোনওদিন ভাল থাকতে পারব। ২০০৮-এর জানুয়ারি মাসে আমি নেশা ছাড়ি। আমাদের ভাষায় বলতে গেলে, মডারেটলি আমি আর কখনও নেশা করতে পারব না। আমার কন্ট্রোলে নেশাটা আর নেই। সেইজন্য যে কোনও মুড-অল্টারিং সাবস্টেন্স থেকে আমি অ্যাবস্টেইন করি। সেক্ষেত্রে অ্যালকোহলও মুড-অল্টারিং সাবস্টেন্স। কিন্তু সিগারেট, কফি, চা— এগুলো কিন্তু মুডকে অল্টার করে না। মানে আমি দুঃখে আছি, চারটে সিগারেট বেশি খেয়ে নিলে দুঃখটাকে এগজাজারেট করে দিল সিগারেট, সেটা কিন্তু হয় না। কফির ক্ষেত্রেও হয় না, কিন্তু অ্যালকোহলের ক্ষেত্রে এটা হয়। অ্যালকোহল, ব্রাউন সুগার— যে সমস্ত সাবস্ট্যান্স সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে প্রভাবিত করে, সেগুলোর প্রত্যেকটাই একটা করে ড্রাগ। অনেকেই বলতে পারে যে, আমার বই পড়ার নেশা আছে। এখন বই পড়াটা তো ভাল জিনিস। কিন্তু সেটা পড়তে গিয়ে যদি দৈনন্দিন জীবনের প্রায়োরিটিগুলো মিস হয়ে যায়, তখন সেটা খারাপ।
তুমি এর আগে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলে যে ৩০তম বার যখন রিহ্যাবে যাও, তখন তুমি শেষ পর্যন্ত নেশাটা থেকে বেরোতে পারো, সেবার বিশেষ কী ঘটেছিল?
অনিন্দ্য: আমার নেশা করার ইচ্ছেটা এত তীব্র ছিল যে, প্রতি বার যখন আমি রিহ্যাব থেকে বেরোচ্ছি, কী লকআপ থেকে বেরোচ্ছি বা পুলিশের মার খাচ্ছি, পকেটে কোনও পয়সা নেই, চুরিচামারি করছি রাস্তায়… প্রতিবারই মনে হচ্ছিল যে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে কিন্তু আবার নতুন দেওয়াল তৈরি হচ্ছে। আজকে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এমন একটা রূপ নিয়ে রয়েছে। কিন্তু, আমার বাবা-মা, আমি যেখানে বড় হয়েছি, সেখানকার মানুষজন জানেন যে আমি কী ছিলাম। একটা সময় পৌঁছে আমার আর নেশা করার অপশনটা ছিল না। আমি সবক’টা অপশন এগজস্ট করে দিয়েছিলাম। আমার চোখের সামনে মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিলাম। হয় মৃত্যু ঘটবে বা তিন বছরের জন্য নন-বেলেবল অফেন্সে জেলে যাব, এইরকম একটা জায়গা। আমি ঠিকমতো চিন্তাভাবনা করতে পারতাম না। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যে, এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে ওভারডোজ হয়ে আমি মরে যাব।
তাহলে আলটিমেটলি কিন্তু তুমি সেলফ-কাউন্সেলিং করেই বিষয়টা থেকে বেরোলে…
অনিন্দ্য: সেলফ-কাউন্সেলিং আমি ঠিক বলব না। আমার কাছে রিয়্যালাইজেশনটা এসেছিল যে, আর অপশন নেই। অপশন ছিল না বলেই একদিন একদিন করে নেশামুক্ত থাকার শুরু। আমি ঠিক করিনি যে, আগামী দশ বছর আমি ভাল থেকে যাব। আমার যুদ্ধটা এখনও প্রতি মুহূর্তে চলে, নিজের সঙ্গে নিজের, যে আজকের দিনটায় আমি নেশা করব না। আর এটার জন্য আমার বাবা-মা তো হেল্প করেছে, এরকম কিছু বন্ধুবান্ধবও রয়েছে যারা সেই লাইফটা দেখে এসেছে এবং তারা আজকের দিনে নেশা ছেড়ে ভাল আছে। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ যে তারা ওই সময়ে বিশ্বাসটা জুগিয়েছিল যে, ‘অনিন্দ্য তুই একদিন নেশামুক্ত থাক, তোর দ্বারা হবে।’ সমাজের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটা তখন জিরো ছিল। আমার বাবা-মা আমাকে বিশ্বাস করত না, আমাকে ২০ টাকা পর্যন্ত দিত না। আমাকে ২০ টাকা দেওয়া মানে আমি জমিয়ে নিয়ে ঠিক নেশা করে ফেলব। এইরকম একটা জায়গা ছিল।
নেশা করাটা মানুষের কাছে একটা চয়েস, কিন্তু নেশার বস্তুর জোগানও একটা বড় প্রশ্ন। কলকাতাতে এই বিশেষ কিছু নেশার জোগান কি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে?
অনিন্দ্য: প্রত্যেকটা মানুষের কাছে নেশার কেমিক্যালস কিন্তু আলাদা। আমার কাছে চয়েস অফ কেমিক্যালস ছিল হেরোইন আর ব্রাউন সুগার। তা ছাড়াও সকালবেলা থেকে আমি ওভার দ্য কাউন্টার ড্রাগস নিতাম, অর্থাৎ যেগুলো ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়। আমি গাঁজা খেতাম, চরস খেতাম। একজন নেশাড়ুর কাছে অনেকগুলো অপশন থাকতে পারে। আজকের দিনে যদি কেউ ব্রাউন সুগার না পায়, সে সুইচ করবে। নেশার অ্যাভেলেবিলিটি যদি কমাতে হয়, তবে সেটা সম্ভব নয়। আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশে আছি, নেশা আমাদের কাছে একটা বড় প্রবলেম। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রথম বিশ্বের দেশেও নেশাটা একটা সমস্যা। আর ওয়ার্ল্ড ইকনমির একটা বড় অংশ জুড়ে কিন্তু রয়েছে ড্রাগ-মানি।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে, সিস্টেমই নেশাকে কখনও বন্ধ হতে দেবে না অর্থাৎ সিস্টেমের ভিতরকার কাউন্টার-সিস্টেম?
অনিন্দ্য: না, ১৯৬০ সালের পরিসংখ্যান আমি যদি দেখি, তখন নেশার পরিমাণ যা ছিল, নেশাড়ুর সংখ্যা যা ছিল, ২০১৭ দাঁড়িয়ে কিন্তু সেটা তিনগুণ হয়ে গিয়েছে। যেটা সম্ভব, এই নেশার থেকে যদি মুক্তি পেতে হয়, তবে একটাই রাস্তা খোলা আছে এবং সেটা হল সচেতনতা। প্রতিদিন নতুন নতুন নেশা আবিষ্কৃত হচ্ছে। আমি এই গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর নতুন ধরনের নেশার আমদানি হতে দেখলাম, যেগুলোর আমি নামই শুনিনি আমি যখন নেশা করতাম। মানুষ নেশা করতে ভালবাসে। পৌরাণিক কাল থেকেই চলে আসছে। এমন কিছু নেশা রয়েছে বা সেরকম কিছু নেশাড়ু রয়েছে যারা সমাজের প্রচুর ক্ষতি করে বসে, যেমন আমি ছিলাম। সেই জায়গায় একটাই রাস্তা খোলা আছে এবং তা হল সচেতনতা ক্রিয়েট করা।
তোমার পরের জেনারেশন, যাদের এখন ১৭-১৮ বছর বয়স, তাদের তুমি কী টিপস বা অ্যাডভাইস দেবে?
অনিন্দ্য: সে নো টু ড্রাগস। একজন নেশাড়ু কিন্তু শুধু নিজের ক্ষতি করে না। আমি মনে করছি যে আমি নেশা করছি, তাতে শুধু আমার ক্ষতি হচ্ছে। আদৌ সেটা নয়, আমি আমার পরিবারের ক্ষতি করছি, সমাজের ক্ষতি করছি, আমার পারিপার্শ্বিক যারা আমার উপর নির্ভরশীল, তাদের সবার ক্ষতি করছি।
এটা তো সবাই জানে, তার পরেও তো নেশা করে মানুষ।
অনিন্দ্য: হ্যাঁ, সবাই জানে কিন্তু ওই বয়সে যেটা হয় এবং যেটা আমার ক্ষেত্রেও ছিল, আমাকে যেটা করতে না বলা হতো, সেটা করতে আমার খুব ভাল লাগত। ইয়ং জেনারেশনের কাছেও তাই। আমি প্রথম সিগারেট খেয়েছিলাম, কারণ আমাকে বলা হয়েছিল সিগারেটটটা না খেতে। রেবেলিয়াস অ্যাটিটিউড থেকেই একজন নেশাড়ু তৈরি হয়। আজকের দিনে যদি কাউকে নেশা করতে হয়, তবে তার কিছু দাম দিতে হবে। সেই দাম যদি কেউ দিতে পারে, ফেয়ার এনাফ, কিন্তু সেই দামটা খুব কস্টলি। আমার ক্ষেত্রে জীবনের ক্রিম একটা সময় নষ্ট হয়েছে, আমার শরীর নষ্ট হয়েছে, সমাজের যে জায়গায় আমি পৌঁছতে পারতাম, সেই জায়গায় পৌঁছতে পারিনি। পড়াশোনা ঠিকমতো করতে পারিনি, বাবা-মার কষ্ট…
অর্থাৎ অভিনেতা হিসেবে তুমি যে জায়গায় যেতে পারতে…
অনিন্দ্য: অভিনেতা হব, সেটা আমি তো ঠিকই করিনি আগে। নেশা ছেড়ে আছি বলে আজ অ্যাক্টর হয়েছি। আমি ভাবিওনি কোনওদিন যে এই জায়গায় আসব। কিন্তু নেশা ছেড়ে থাকলে যে অনেক কিছু পাওয়া যায়, আমি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। যারা আজকের দিনে নেশা করছে, তাদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছতে পারি যে নেশা ছেড়ে ভাল থাকা যায় আর যদি নেশা করতেই হয়, তবে এটা মাথায় রাখা উচিত যে তার একটা কনসিকোয়েন্স রয়েছে। আজ অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় সেলিব্রিটি কিন্তু এই অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে কেউ চিনত না, যখন সে শিয়ালদা স্টেশনে পড়ে থাকত, পুলিশের মার খেত। সেই দামটা দিতে হবে।