মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিয়ে করে ভারতের লক্ষ্ণৌ থেকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পাড়ি জমান কণিকা কাপুর। তাঁর স্বামী রাজ চন্দক লন্ডনপ্রবাসী ভারতীয় ব্যবসায়ী। সেই দেশে তাঁর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। কোনো কিছুর অভাব ছিল না। মাত্র ২৬ বছর বয়সে কণিকা তিন সন্তানের মা হয়ে যান। স্বামী-সন্তান নিয়ে একেবারে আটপৌড়ে ঘরনি ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই গৃহিণী হঠাৎ চলে এলেন বলিউডে। এক ‘বেবি ডল’ গান দিয়ে সাড়া ফেলে দিলেন সবখানে। কিন্তু আইটেম গান করেছেন বলে, কণিকাকে কিন্তু হালকাভাবে নেবেন না। এই মেয়ে জীবনের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। কোটিপতি স্বামীর ঘর ছেড়েছেন চার বছর হলো। একটা সময় হতাশ হয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে চেয়েছিলেন। সেই কণিকাই এখন তাঁর তিন সন্তানকে বড় করছেন। সেই সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েছেন নিজের মা-বাবারও।
কণিকা ও তাঁর সাবেক স্বামী রাজ১৯৯৭ সালে ভারতের খাজুরাহোতে এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে রাজ চন্দকের সঙ্গে পরিচয় হয় কণিকার, তার পর প্রেম। এর আগ পর্যন্ত কণিকার জীবন ছিল গান আর সুরে ভরা। তিনি পড়াশোনা করেছেন শাস্ত্রীয় সংগীত বিষয়ে। ছয় বছর বয়স থেকে গান শিখতেন। যে বছর রাজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, সে বছরই গায়িকা হিসেবে ভাগ্য যাচাই করতে মুম্বাইও গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাজের সঙ্গে পরিচয়ের পর বদলে যায় সব। রাজ ছিলেন লন্ডনপ্রবাসী ধনকুবের। তাই কণিকার মা-বাবা মেয়ের মাথার বলিউডের ভূত ঝেড়ে ফেলতে তড়িঘড়ি করেই তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। কণিকাও দারুণ খুশি হয়ে রাজের সঙ্গে সংসার করতে চলে যান ভিনদেশে। সেখানে বিলাসবহুল বাড়ি, দামি গাড়ি, ডিজাইনার, জামা-জুতা আর বিশ্বভ্রমণের মোহ পেয়ে বসে তাঁকে। তিন সন্তানের জন্মের পর মাত্র ২৬ বছর বয়সেই মুটিয়ে যাওয়া কণিকাকে দেখে তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘এ কী অবস্থা তোমার! তোমাকে তো এখন মাঝবয়সী পাঞ্জাবি আন্টিদের মতো দেখাচ্ছে!’ তবুও কণিকা সুখেই ছিলেন।
.কিন্তু একটা সময় হঠাৎ কণিকা জানতে পারেন তাঁর স্বামী রাজের পরকীয়ার কথা। এক পাকিস্তানি নারীর সঙ্গে প্রেম চলছিল রাজের। বিষয়টি জানাজানি হলে কণিকার কাছে ক্ষমা চান রাজ। নতুন করে সম্পর্কটায় প্রাণ ঢালতে চান। তাই নিজেদের দশম বিবাহবার্ষিকীতে কণিকাকে তিনি উপহার হিসেবে একটি গানের অ্যালবাম করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সে অনুযায়ী লন্ডনেরই এক মিউজিক অ্যারেঞ্জারকে ৪০ হাজার পাউন্ড দেন তিনি। কিন্তু এতেও কিছু ঠিক হয় না। ক্ষমা চাইলেও রাজ সেই প্রেম ভুলতে পারেন না। আর কণিকাও তাঁর গানে মন দিতে পারেন না। একটা গান করেই গায়িকা হওয়ার স্বপ্নে ‘ফুলস্টপ’ দেন কণিকা। তবে ‘জুগনি’ নামের সেই গানের একটা ভিডিও তৈরি করেন তিনি। স্বামীর ফেরারি গাড়ি আর বিশাল ফ্ল্যাটে চলে দিনভর শুটিং। কিন্তু কণিকার কাছে তখন এসব কোনো বিষয় ছিল না। সে তাঁর সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু শেষ নাগাদ পারেননি। ২০০৮ সালে আলাদা থাকতে শুরু করেন কণিকা ও রাজ।
.২০১২ সালের জুলাইয়ে কণিকা ও রাজের বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়। মাঝের এই সময়টা দারুণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কাটে তাঁর। ফেরারি আর রেঞ্জ রোভারে চড়া কণিকাকে তখন বাস আর টিউবে (দ্রুত গতির ট্রেন) চড়তে হতো, বিশাল বাড়ি ছেড়ে উঠতে হয়েছিল ছোট ফ্ল্যাটে। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণে লন্ডনপ্রবাসী ভারতীয় কমিউনিটির সবাই নাকি কণিকাকে নিয়ে অনেক কান কথাও বলতে শুরু করেছিল। হতাশা আর অবসাদ নাকি তাঁকে এমনভাবে ধরেছিল, যে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি।
এরই মধ্যে একদিন কণিকার কাছে ভারত থেকে একটা ফোন আসে। সময়টা ২০১৩ সাল। ফোনের ওপাশে ছিলেন সংগীত পরিচালক মনমিত (মিত ব্রাদার্স জুটির একজন)। তিনি ছিলেন কণিকার বড় ভাইয়ের বন্ধু। মনমিত জানান, কণিকার ‘জুগনি’ গানটা বলিউডের প্রযোজক একতা কাপুরের খুব মনে ধরেছে। একতা চান তাঁর একটি ছবির জন্য কণিকা যেন ‘বেবি ডল’ গানটা করেন। কণিকা সেই ডাকে সাড়া দেন। গানে কণ্ঠ দেন তিনি। কিন্তু সে সময় কণিকার আর্থিক ও মানসিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে গানটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে লন্ডন থেকে ভারতে আসার আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না তাঁর। সে সময় কণিকার চিকিৎসা চলছিল। তবে ‘বেবি ডল’ গানটি মুক্তির দুই সপ্তাহের মধ্যে পাল্টে যায় তাঁর জীবন। একটা সময় যে প্রতিবেশী ও স্বজনেরা তাঁকে ‘অপয়া’ বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, তাঁরাই কণিকার সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য লাইন দিতে শুরু করে।
এরপরের গল্পগুলো তো সবারই জানা। ‘বেবি ডল’-এর পর কণিকার গাওয়া ‘টেডি বিয়ার’, রয় ছবির ‘চিটিয়া কালাইয়া’, হ্যাপি নিউ ইয়ার-এর ‘লাভলি’, দিলওয়ালের ‘টুকুর টুকুর’ আর সাম্প্রতিক ‘হাগ মি’ ও ‘লাভ লেটার’-এর সাফল্যের কারণে তিনি এখন সচ্ছল। এক ছেলে দুই মেয়ে নিয়ে কণিকা এখন স্বাবলম্বী।
টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে
বিষয়:
বলিউড আনন্দ