‘
হুমায়ূন আহমেদ কয়টা পুরস্কার পেয়েছেন? কিংবা হুমায়ুন ফরীদি?’ প্রশ্নটা করে উত্তরের অপেক্ষা করলেন না অভিনেতা মোশাররফ করিম। বললেন, ‘আমরা কিন্তু কেউই জানি না তাঁরা কতগুলো পুরস্কার, কেন পেয়েছেন? কিন্তু আমরা তাঁদের জানি। তাঁদের লেখা ও অভিনয় তৈরি করেছে হাজারো ভক্ত, অনুরাগী। আমার কাছেও পুরস্কারটা তাই কোনো ব্যাপার নয়। রাস্তায় বের হলে বাবার বয়সী বৃদ্ধ যখন আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরেন, এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী আছে?’
কথাগুলো বলে থামলেন এ সময়ের জনপ্রিয় এ অভিনেতা। গেল সোমবার সকালে তাঁর বাসায় বসে যখন কথা হচ্ছিল তখন বাইরে কড়া রোদ। ভেতরে আমরা কিছু নরম কথা শোনার আশায় বসেছি। কিন্তু পুরস্কার নিয়ে কথা তুলতেই খানিকটা কড়া ‘মেজাজ’ই ভর করল খানিক আগে ঘুম থেকে ওঠা মোশাররফ করিমের কথায়। আগের দিন শুটিং শেষ করে অনেক রাতে ফিরে ঘুমিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠে ঘরের পোশাকেই সামনে এসেছেন। আলোকচিত্রীর দিকে তাকিয়ে ছবি তোলার ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেই বললেন, ‘এভাবেই তুলি। কী বলেন? এমন না যে লোকজন আমাকে লুঙ্গি ও টি-শার্ট পরা দেখেননি। নাটকে দেখে থাকলে পত্রিকায় সমস্যা কী?’
বললেন বটে, কিন্তু ভেতরে গেলেন পোশাক পরিবর্তনের জন্য। ততক্ষণে রামপুরায় মোশাররফ করিমের বাসা বলে যে বাড়িটা লোকের চেনা সেই বাড়িটার বসার ঘর একটা অস্থায়ী স্টুডিওতে রূপদান করে ফেলেছেন আলোকচিত্রী। বার কয়েক ফ্লাশ জ্বালিয়ে পরীক্ষা করা হলো ‘লাইট’ও। তবে ছবি বাড়িতে না বাইরে তোলা হবে, তা নিয়ে সংশয় তখনো কাটেনি।
প্রসঙ্গ মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার
এ বছর ২৯ এপ্রিল আয়োজন করা হয়েছিল মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৫-এর। তারকা জরিপে গেল কয়েক বছরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন মোশাররফ করিম। সিকান্দার বক্স এখন নিজ গ্রামে নাটকে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন। অবশ্য পুরস্কার হাতে নেওয়ার আগ পর্যন্ত সামনের সারিতে স্ত্রী রোবেনা রেজাকে সঙ্গে নিয়ে বসে ছিলেন তিনি। নাম ঘোষণার পর মঞ্চে উঠে গেলে স্ত্রী বলছিলেন, ‘এবার শুধু পুরস্কার দিলে হবে না, একটা শোকেসও দিতে হবে। আর রাখার জায়গা পাচ্ছি না।’
তাঁর কথার সত্যতা মিলল বাসায় ঢুকেই। বুকশেলফ, বসার ঘরের টেবিল, শোকেসে ছড়িয়ে আছে মোশাররফ করিমের দৃশ্যমান অর্জন। এর মধ্যে মেরিল-প্রথম আলো থেকেই পেয়েছেন আটটি। প্রথম পান ২০০৮ সালে। দেয়াল আলমারি নাটকের জন্য সমালোচক পুরস্কার। তারপর ২০১০ বাদ দিয়ে প্রতিবছরই মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার জায়গা করে নিয়েছে মোশাররফ করিমের রামপুরার বাসায়। এর মধ্যে সমালোচক তিনটি এবং তারকা জরিপ পাঁচটি। এত পুরস্কারের মধ্যে কোনটা তাঁর কাছে সেরা?
প্রশ্নটা শুনে হাসলেন একটু। বললেন, ‘এখন তো অত কিছু মনে নেই। তবে দেয়াল আলমারি নাটকে অভিনয় করে ভালো লেগেছে। আর ২০১৩ সালে পেয়েছিলাম সেই রকম চা খোর নাটকে অভিনয়ের জন্য। এই নাটকের গল্পটা অসাধারণ। খুব আনন্দ নিয়ে অভিনয় করেছিলাম।’
আর ভালোবাসা চাই না!
আবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেম কানায় কানায় পূর্ণ। তারকা জরিপের সেরা টেলিভিশন অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠেছেন মোশাররফ করিম। অবধারিতভাবেই হাততালির মাত্রা বেড়ে গেছে এবার। মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ওপরদিকে তাকালেন তিনি। হাসিমুখে বললেন, ‘আমি আর ভালোবাসা নিতে পারছি না। এত ভালোবাইসেন না আমাকে!’
এই কথার রহস্য জানতেই ঘটনাটা মনে করিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। খোলাসা করলেন তিনি, ‘আমি আসলে সেদিন হয়তো ঠিকমতো বোঝাতে পারিনি। আমি বলতে চেয়েছি, আমি খুব সাধারণ। দর্শকেরা আমাকে এত ভালোবাসেন যে এটা আমার কাছে মনে হয়, “এ মণিহার আমায় নাহি সাজে”। এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা কি আমার আছে? আমি শুধু সৎ থেকে আমার কাজটুকু ভালোমতো করার চেষ্টা করি। আজীবন সেটাই করব। কিন্তু মানুষ কেন এত ভালোবাসে আমাকে, সেটা আমার কাছে একটা রহস্য। আমি রীতিমতো বিস্মিত। আমারও খুব ইচ্ছে করে পাড়ার মোড়ে দোকানে বসে চা খেতে, আড্ডা দিতে। কিন্তু পারি না। যদিও এই না পারার জন্য আমিই দায়ী। তবুও দর্শকদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।’
…এবং অভিনয়জীবন
এই সময়ের নাটকের অবস্থা নিয়ে অকপটে অনেক কথাই বললেন। যার কিছু অপ্রকাশিতই থাকবে চিরকাল।
বললেন, ‘আমাদের অতীত ভুলে গেলে হবে না। এই যে আমরা এখন ক্রিকেট বলতে অজ্ঞান, এই অবস্থাটা কিন্তু যেদিন আকরাম খানরা বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করল সেদিনের ফসল। তাই পেছন ফিরে তাকাতেই হবে। আর একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, শিল্প কিন্তু সবচেয়ে বেশি সততা দাবি করে। এটার কোনো মাপকাঠি নেই। শিল্পী যদি মনে করেন সততার সঙ্গে কাজটি করে সবার সামনে উপস্থাপন করেছেন, তাহলেই সেটি সেরা কাজ। আর সৎ থাকলে পুরস্কার আসবেই। এটার জন্য এত হাহাকার করতে হয় না।’
নাটক নিয়ে বললেন, ‘জানি, এই সময়ের নাটকের অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু যে অবস্থায় নাটক নির্মাণ হয় সেটি জানলে সাধুবাদ পাওয়ার কথা। এত প্রতিবন্ধকতা সামলে যিনি নাটক নির্মাণের সাহস রাখেন, তাঁকে আসলেই স্যালুট করতে হয়। তবে নাটক-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছে অনুরোধ, শুধু ব্যবসাটা না বুঝে একটু শিল্পটাও বুঝুন। আপনারা আর একটু শিল্পমনস্ক হলেই যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’