এবারও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা নায়ক-নায়িকা নির্বাচিত হয়েছেন মৌসুমী ও ফেরদৌস। এর আগে তাঁরা দুজন একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে আনন্দের পাঠক তো জানেন বিস্তর। তাহলে নতুন কিছু করা দরকার—ফেরদৌস আর মৌসুমী একে অন্যকে প্রশ্ন করবেন, দেবেন উত্তর। সানন্দেই রাজি হয়ে গেলেন তাঁরা। আর কথা যখন শুরু করলেন, তখন তা যেন আর শেষ হতে চায় না…
মৌসুমীকে ফেরদৌসের প্রশ্ন
ফেরদৌস: আমরা যখন প্রথম চলচ্চিত্রে এলাম, তখন এমন একটা কথা প্রায়ই শুনতাম, ইন্ডাস্ট্রিতে মৌসুমীর আশিকের (প্রেমিকের) সংখ্যা এত বেশি যে, নতুন করে কেউ প্রেম নিবেদন করতে হলে সেই মানুষকে বাসার সামনে গিয়ে ইট দিয়ে আসতে হয়…
মৌসুমী: ছি ছি! এটা কোনো কথা হলো?
ফেরদৌস: না না, আমি আসলে জানতে চাচ্ছি, সেই আশিকদের সংখ্যা নিশ্চয়ই এখনো কমেনি?
মৌসুমী: আমি তো জানি না। আমি দরজার এক পাশে থাকি। অন্য পাশে হয়তো অনেক কিছুই হয় (হাসি)।
ফেরদৌস: আপনি যখন চলচ্চিত্রে এসেছিলেন, তখন চলচ্চিত্রে আন্তরিকতা ছিল, মজা ছিল। এফডিসিতে একটা সময় গেলে দেখা যেত, আটটা-নয়টা সিনেমার শুটিং হচ্ছে। মনে হতো যেন সিনেমার মেলা হচ্ছে। আমার নিজের শুটিং না থাকলে মন খারাপ হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যেমন টিএসসিতে না গেলে পেটের ভাত হজম হতো না, এফডিসির গেট দিয়ে ঢুকলে মনে হতো নিরাপদ একটা জায়গায় চলে এসেছি…
মৌসুমী: একদম ঠিক বলেছ, ফেরদৌস। আগে এফডিসিতে ঢুকলেই এখানে শাবনূরের কাজ, ওখানে পূর্ণিমা ও পপির কাজ। আর আছে মান্না ভাই, কাঞ্চন ভাই, রুবেল ভাই, সানীর কাজ। পুরো এফডিসি জমজমাট ছিল। এখন তো খাঁ খাঁ। খুব এতিম এতিম লাগে। আমার এখন মান্না ভাইয়ের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ফেরদৌস, মনে আছে, একটা সময় তোমার-আমার অনেকগুলো কাজ হচ্ছিল একসঙ্গে। আমি মান্না ভাইয়ের সঙ্গে রাগ করলাম। তাই আমি চাইছিলাম না যে, মান্না ভাইয়ের সঙ্গে নতুন কোনো কাজ করতে। একসঙ্গে কয়েকটা ছবির অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে তিনি ভীষণ রাগ করেন। মান্না ভাই মারা যাওয়ার চার দিন আগে সানীকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, আমার সঙ্গে যেন কথা বলিয়ে দেয়। এরপর সানী আমাকে ফোনটা দিল। মান্না ভাই তখন বললেন, ‘শোনো মৌসুমী, বিশ্বাস করো, এফডিসিতে এলে আমার মনে হয়, আমি এতিম। প্রতিদিন এত কাজ করি, আমার ভালো লাগে না। প্লিজ, আমি চার-পাঁচটা ছবি পাঠাই, তুমি করো।’ এটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা। একই অনুভূতি আমার এখন হয়। আমি সেদিন বুঝিনি মান্না ভাইয়ের কথাটা। এখন বুঝি।
ফেরদৌস ও মৌসুমী। ছবি: কবির হোসেনফেরদৌস: আপনাকে আমরা নিজেরা মিলে শিল্পী সমিতির সভাপতিও করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি রাজি হননি।
মৌসুমী: শিল্পী সমিতির সভাপতি হয়ে তেমন কিছু করা সম্ভব নয়। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে কোনো নিয়মকানুনের বালাই নেই। নিয়ম না থাকার কারণে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক কেমন যেন হয়ে যায়। একটা সিস্টেম থাকলে কারও মধ্যে এই ব্যাপারটি জন্ম নেবে না।
ফেরদৌস: আমাদের সময় কেউ একজন অন্যায় করলে হয়তো মান্না ভাইয়ের কাছে নালিশ করত। মান্না ভাই এসে আমাকে বকা দিলে আমি শুনতাম। আমাদের সময় শিল্পীদের মধ্যে শ্রদ্ধা ছিল।
মৌসুমী: ফেরদৌস, দেখো, এখনো কিন্তু আমাদের প্রজন্মের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ আছে। যেমন ধরো, এখন যদি আমাকে আলমগীর ভাই বলেন, মৌসুমী, তুমি এটা করো, আমার পক্ষে কখনোই না করা সম্ভব নয়। ফেরদৌসকে যদি বলা হয়, মৌসুমী এটা করতে বলেছে, আমার বিশ্বাস, সে-ও না করবে না।
ফেরদৌস: একদম তাই। এই যে এত কিছু বললেন, এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
মৌসুমী: এখানে শিক্ষা অনেক বড় একটা ব্যাপার। সবার যদি ন্যূনতম পারিবারিক শিক্ষা থাকত, তাহলে অনেক সংকটই এড়ানো যেত। দায়বদ্ধতা আর শ্রদ্ধাবোধও অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর।
ফেরদৌস: আপনাকে যদি এই মুহূর্তে কোনো অনুষ্ঠান উপস্থাপনার প্রস্তাব দেওয়া হয়, যেমন ‘কে হতে চায় কোটিপতি’, আবার যুক্তরাষ্ট্রে যেমন হয়, ‘লুক ইউ ক্যান ডান্স’—তাহলে কী করবেন?
মৌসুমী: ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ ধরনের অনুষ্ঠান আমি উপস্থাপনা করব। আমি উপস্থাপনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। তবে সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হলে করতে পারি।
ফেরদৌসকে মৌসুমীর প্রশ্ন
মৌসুমী: তুমি যখন বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ো, কতক্ষণ বাসার কথা তোমার মনে থাকে?
ফেরদৌস: যাত্রাপথে সারাক্ষণ মনে থাকে। কাজে ঢুকে গেলে আস্তে আস্তে মন থেকে বাসার কথা মুছে যায়।
মৌসুমী: তোমার ভালোবাসার মানুষ, হতে পারে সে তোমার বন্ধু, স্ত্রী, মা, বোন—এঁদের মধ্যে কেউ যদি বড় একটা অন্যায় করে তোমার কাছে আসে, তবে তুমি কী করবে?
ফেরদৌস: যদি সেটা ছোট অন্যায়ও হয়, তাহলে তার কিছুটা হলেও শাস্তি পেতে হবে। যদি শাস্তি না পেয়ে বেরিয়ে যায়, তাহলে অপরাধ বারবার ঘটবে।
মৌসুমী: হঠাৎ করে যদি তোমার বউ এসে বলে তোমার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। তোমার সঙ্গে আর থাকা সম্ভব নয়। বাচ্চা দুটো রেখে চলে যাবে?
ফেরদৌস: প্রথমত এটা হওয়ার কোনো কারণই নেই। আর যদি সত্যিই তেমন কিছু ঘটে, তবে বাচ্চা দুটোর চাপ আমার বউ সামলাতে পারবে না। তাই সে আমাকে বাচ্চাসহ বিদায় করবে। আমিও খুব খুশি মনে হাসতে হাসতে বের হয়ে যাব। (হাসি) আমরা খুব সুন্দর একটা সময় কাটালাম। আবার এভাবে বসতে পারলে ভালো লাগবে।
মৌসুমী: আমারও।
সাক্ষাৎকারের সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন মনজুর কাদের