মাত্র ছয় বছরের অভিনয়জীবন। মৃত্যু হয়েছিল উনিশ বছর বয়সে। দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা না খুন ? তার মৃত্যুকে ঘিরে এমন অনেক প্রশ্ন তাড়িত করেছে তার ভক্তদের। তিনি দিব্যা ভারতী।
দিব্যা ভারতীর জন্ম মুম্বাইতে ১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বাবা ওম প্রকাশ ভারতী এবং মা মিতা ভারতীর সন্তান দিব্যা ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন । প্রায়ই স্কুলের পড়া বাদ দিয়ে হিন্দি ছবির নাচ অনুশীলন করতেন। ছাত্রী হিসেবেও ছিলেন মাঝারি মানের। নবম শ্রেণিতে উঠে তিনি অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন।
দিব্যা ভারতী অনেকগুলো হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পান। তিনি নাচ শিখতে থাকেন। কয়েকটি ছবির কাজ শুরুও করেন। কিন্তু তার বয়স কম হওয়ায় অভিনয়ে পরিপক্কতা ছিল না। এজন্য দুয়েকটি ছবি থেকে বাদ পড়ে যান। রূপালি পর্দায় তার অভিষেক ঘটে তেলেগু ছবির মাধ্যমে। তেলেগু ছবির খ্যাতিমান প্রযোজক ডি রামানাইড়ু ‘ববিলি রাজা’ –সিনেমায় নিজের ছেলের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে তাকে সুযোগ দেন। ১৯৯০ সালে ‘ববিলি রাজা’ মুক্তি পায়। সুপার ডুপার হিট এ ছবির দৌলতে রাতারাতি তারকা বনে যান দিব্যা। পর পর বেশ কয়েকটি তেলেগু ছবিতে নায়িকা হন তিনি। প্রতিটি ছবিই বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়। ফলে তেলেগু ছবির জগতে সুন্দরী দিব্যা ভারতী জনপ্রিয় তারকা হয়ে ওঠেন। তার তামিল ছবি ‘নিলা পেননে’ সাফল্য না পেলেও তেলেগু চলচ্চিত্রে তার দাপট বাড়তে থাকে। এমনকি তেলেগু সিনেমার মহাতারকা বিজয়া শান্তির সঙ্গে তুলনা করা হতে থাকে তার।
এবার বলিউডের নামকরা পরিচালকদের নজরে পড়েন তিনি। বলিউডে দিব্যার অভিষেক ঘটে রাজিব রাই পরিচালিত ‘বিশ্বাত্মা’ ছবির মাধ্যমে। সানি দেওলের বিপরীতে ছবিটি ব্যবসাসফল হয়। বিশেষ করে ছবির গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়। ‘সাত সামুন্দার পার’ গানের সঙ্গে তার অভিনয় তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। সব সিনে ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে দিব্যার অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা ঠাঁই পেতে শুরু করে। পরবর্তী ছবি ‘দিল কা ক্যায়া কাসুর’ হিট না হলেও তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। এ ছবির গানগুলোও জনপ্রিয়তা পায়। ‘গা রাহা হু ইস মাহফিলমে’ গানটিতে দিব্যার অভিব্যক্তি ছিল অনবদ্য।
১৯৯২ সালে ডেভিড ধাওয়ানের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘শোলা অউর শবনম’। গোবিন্দর বিপরীতে এই ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হয়। এ ছবিতে সাঁতারের পোশাকে আবির্ভূত হয়ে সাড়া ফেলে দেন দেন দিব্যা। দর্শকের হৃদয়ে রাজত্ব করতে শুরু করেন তিনি।
এরপর মুক্তি পায় রাজ কানওয়ার পরিচালিত ‘দিওয়ানা’। ছবিটিতে ঋষি কাপুর ও নবাগত শাখরুখ খানের বিপরীতে দিব্যা ছিলেন অনবদ্য। শাহরুখ ও দিব্যা এর আগেই অবশ্য হেমা মালিনী পরিচালিত ‘দিল আশনা হ্যায়’তে অভিনয় করেছিলেন। তবে ছবিটি মুক্তি পায় ‘দিওয়ানা’র পরে। ‘দিল আশানা হ্যায়’তে মূলত নায়িকা ছিলেন ডিম্পল কাপাডিয়া, সোনু ওয়ালিয়া এবং অমৃতা সিং। আর ‘দিওয়ানা’তে দিব্যাই একক নায়িকা এবং ছবির কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯২ সালের সেরা হিট ছবি ছিল ‘দিওয়ানা’। এ ছবির ‘তেরা নাম রাখ দিয়া’সহ সবগুলো গান ছিল সুপারহিট। সিনেমায় দিব্যার চমক জাগানো নিষ্পাপ সৌন্দর্য তাকে হিন্দি ছবির অন্যতম সেরা সুন্দরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। এ ছবিতে তার অভিনয়ও ছিল প্রশংসাযোগ্য। এই ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে ফিল্মফেয়ার আসরে দিব্যা ও শাহরুখ দুজনে লাক্স ফেইস অফ দ্যা ইয়ার পুরস্কার জয় করেন। ১৯৯২ সালে আরো মুক্তি পায় গোবিন্দর বিপরীতে ‘জান সে পেয়ারা’, অবিনাশ ওয়াধাওয়ানের বিপরীতে ‘গীত’, আরমান কোহলির বিপরীতে ‘দুশমন জমানা’ এবং নবাগত সুনীল শেঠির বিপরীতে ‘বলবান’। সবগুলো ছবিই ছিল ব্যবসাসফল। হিন্দি ছবিতে ব্যস্ততা সত্ত্বেও তেলেগু ছবিতে কাজ চালিযে যাচ্ছিলেন দিব্যা। সে বছর তার অভিনীত তেলেগু ছবি ‘চিত্তামা মগোদু’ দারুণ ব্যবসাসফল হয়। সিনেমায় তার নায়ক ছিলেন মোহন বাবু।
দিব্যা ভারতী অভিনীত ‘ক্ষত্রিয়’ মুক্তি পায় তার শোচনীয় মৃত্যুর মাত্র দশদিন আগে। ছবিতে আরো ছিলেন সানি দেওল, সঞ্জয় দত্ত এবং রাভিনা ট্যান্ডন। ছবিটি ছিল ব্যবসাসফল।
দিব্যার মৃত্যুর পর মুক্তি পায় তেলেগু ছবি ‘থোলি মুডধু’ এবং হিন্দি ‘রং’ ও ‘শতরঞ্জ’। সবগুলো ছবি সুপারহিট হয়। আরো অনেকগুলো ছবিতে তার অভিনয় করার কথা ছিল বা কিছুটা কাজ করেছিলেন। সেই ছবিগুলোতে পরে তার পরিবর্তে অন্য নায়িকাদের নেওয়া হয়। ‘লাডলা’, ‘মোহরা’, ‘কর্তব্য’, ‘বিজয়পথ’ প্রতিটি হিট ছবিতেই নায়িকা হওয়ার কথা ছিল দিব্যা ভারতীর।
‘শোলা আউর শবনম’ ছবির সেটে দিব্যার সঙ্গে পরিচয় হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক সাজিদ নাদিয়াদওয়ালার। পরিচয় খুব দ্রুতই প্রেমে গড়ায়। ১৯৯২ সালের ১০ মে তারা বিয়ে করেন। বিয়ে হয় ইসলামি রীতিতে। দিব্যা ভারতী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তার নাম হয় সানাহ নাদিয়াদওয়ালা।
১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল রাত পৌনে বারোটার দিকে মুম্বাইয়ের ভারসোভায় পাঁচতলা ভবন তুলসীতে নিজের ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে নিচে পড়ে যান দিব্যা। গাড়ি পার্কিং- এ মাটির উপর আছড়ে পড়ে তার দেহ।
সে সময় দিব্যার ফ্ল্যাটে উপস্থিত ছিলেন তার বান্ধবী ফ্যাশন ডিজাইনার নিতা লুল্লা ও তার স্বামী। তবে তারা তখন লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছিলেন। তাদের পেছনে লিভিং রুমের বিশাল কাঁচের জানালা দিয়ে দিব্যা পড়ে যান।
দিব্যার পড়ার শব্দে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। তারা রক্তাক্ত দিব্যা ভারতীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। পুলিশ আসে। মুম্বাইয়ের কুপার হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দিব্যা ভারতী। শরীরের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং মাথার পেছনে গুরুতর আঘাতে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু তার পড়ে যাওয়ার কারণ অস্পষ্টই থেকে যায়। এটিকে নিছক দূর্ঘটনা বলে মেনে নিতে পারেননি তার ভক্তরা। শাশুড়ি ও স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্কের বেশ টানাপড়েন চলছিল। তিনি সেজন্য আত্মহত্যা করেন একথা অনেকের মুখে শোনা যায়। আবার সাজিদ নাদিয়াদওয়ালার সঙ্গে মুম্বাই ও দুবাইয়ের আন্ডার ওয়ার্ল্ডের লোকজনের যোগাযোগ ছিল বলে তাকে হত্যা করা হয়েছে এমন গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ শেষ পর্যন্ত অপমৃত্যু বলে তার মৃত্যুর তদন্ত বন্ধ করে।
দিব্যা ভারতীর মৃত্যু হয়েছে ২৩ বছর আগে। বলিউডের আকাশে উল্কার মতো ক্ষণস্থায়ী কিন্তু উজ্জল ছিল তার অভিনয়জীবন।
মাত্র উনিশ বছরের জীবনে তিনি পেয়েছিলেন নাম, খ্যাতি, অর্থ সবই। আর পেয়েছিলেন ভক্তদের অপরিসীম ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাই এই অকালমৃত সুন্দরী অভিনেত্রীকে অমর করে রেখেছে।